Bangladesh
সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর বাংলাদেশের মাদ্রাসা
ঢাকা, নভেম্বর ১২: বাংলাদেশে দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লা চৌমুহনী, রংপুরের পীরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রসঙ্গে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুদ্দীন আহমেদ মানিক বলেছেন, মাদ্রাসাগুলো সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর আঁতুড় ঘর এবং দেশের অসাম্প্রদায়িক নীতি ও চিন্তা - চেতনার পরিপন্থী এ ধরণের প্রতিষ্ঠানগুলিকে অবশ্যই সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এক সমাবেশে সম্প্রতি এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, একটি দেশে দুই ধরনের পড়াশোনা চলতে পারে না।
তিনি বলেন, 'এই কাজ তাদের, যারা একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, যাদের কাজ ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা। তারা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। তাদের উচিত এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। একাত্তরে তাদের একবার পরাজিত করেছি আবারও তাদের পরাজিত করতে হবে।'
সমাবেশে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম; বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর; গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।
সভায় সংহতি জানান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুদ্দীন আহমেদ মানিক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম; বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী; সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ; রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য; প্রজন্ম একাত্তরের আসিফ মুনীর; হিন্দু, বৌদ্ধ, খিস্ট্রান ঐক্য পরিষদের উপদেষ্টা কাজল দেবনাথ; স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন কর্মকার; আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, কুমিল্লা ও রংপুরের ঘটনা সরেজমিনে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। মন্দিরে ও বসতবাড়িতে হামলায় তাদের অন্তরে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। তা অর্থ দিয়ে পূরণ করা যাবেনা। এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য আমাদের রাজনীতি যাতে সাম্প্রদায়িক না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বাংলাদেশে এই ধরণের ধর্মীয় শক্তিগুলি ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করে গেছে। "পলিটিকাল ইকনমি অফ মাদ্রাসা এডুকেশন ইন বাংলাদেশ" গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক আবুল বরকতের হিসেব মত, ১৯৭০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা ২,৭২১ থেকে বেড়ে হয়েছিল ১৪,১৫২ এবং কাওয়ামী মাদ্রাসাগুলির সংখ্যা বেড়ে ১৩,৯০২ (২০১৫ সালের সরকারি হিসেব) থেকে ৩৩,০০০ এর মধ্যে (বাংলা ট্রিবিউন, জানুয়ারি ২০,২০২০)। এই সব সংখ্যার মধ্যে কিন্তু ৭০,০০০ মসজিদ-কেন্দ্রিক মক্তব এবং ৪,০০০ হাফেজিয়া মাদ্রাসাকে (২০০৮ সালের হিসেব) ধরা হয়নি।
পাঠ্যবস্তু এবং পরীক্ষার মানের ব্যাপারে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কাওয়ামী মাদ্রাসাগুলি ২০১৭ সালে তাদের দওরাহ-এ-হাদিথ ডিগ্রির স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। এর থেকেই তাদের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্বের আভাস পাওয়া যায়। এই ডিগ্রিকে সরকারি স্নাতোকত্তর ডিগ্রির সমতুল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, যে ভাবে এরা প্রকাশ্যে হাইকোর্ট চত্বর থেকে আইনের সার্বজনীন প্রতীক লেডি জাস্টিস মূর্তি অপসারনের দাবি তুলেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাতে সফলও হল, তার থেকে এদের শক্তি এবং নাছোড় ইচ্ছার আরও একটি চমকপ্রদ প্রমাণ পাওয়া যায়। ইসলামের ভাবধারার সঙ্গে মূর্তি সঙ্গতিপূর্ন নয়, এই অজুহাতেই এই দাবি তোলা হয়েছিল।
বাংলাদেশে যথেচ্ছ ভাবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হওয়া এ ব্যাপারে একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। এই সব মাদ্রাসাগুলির অনেকগুলিই ইসলামি জঙ্গিবাদ এবং জিহাদি কার্যকলাপ বাড়িয়ে তুলেছে বলে দেখা গেছে। এই ধরণের বহু প্রতিষ্ঠানেই ইসলামি জঙ্গিদের শিবির করা হয়েছে বলে একটি সমীক্ষায় প্রকাশ। এই শিবিরগুলির সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ থাকে। শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করা এবং ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপনের লক্ষ্যে অস্ত্র শিক্ষা দেওয়া হয় এ সব জায়গায়। ওসামা বিন লাদেন এবং তালিবান নেতা মোল্লা ওমরের স্তুতি সমৃদ্ধ অডিও এবং ভিডিও ক্যাসেট চালিয়ে শিক্ষার্থীদের নাশকতামূলক কাজ প্ররোচিত করার কাজ ব্যাপক ভাবে করা হয় এই সব শিবিরে।
যা আশ্চর্যের, তা হল অধিকাংশ মাদ্রাসাতেই স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের মত জাতীয় দিবসগুলি পালন করা হয়না। এমন কি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করা অথবা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়াকে গৌরবান্বিত করা হয় এ সব জায়গায় জিহাদের শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে। বেশ কিছু এই ধরণের প্রতিষ্ঠানে কোনও উপলক্ষ্যেই জাতীয় পতাকা পর্যন্ত তোলা হয়না, জাতীয় সংগীত গাইতে দেওয়া হয়না ছাত্র ছাত্রীদের।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই সব মাদ্রাদসার পড়ুয়া এবং শিক্ষকরা নারীদের বিরু্দ্ধে ধর্মীয় নেতাদের 'ফতোয়া' ঘোষণার পক্ষে। এন জি ও গুলির উন্নয়নমূলক কাজ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, পরিবার পরিকল্পনা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং অগ্রগতি, নারী-নেতৃত্ব, পশ্চিমি শিক্ষা, বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতিকে দেশে ইসলাম সম্পর্কিত উৎসাহের প্রতিবন্ধক বলে এরা মনে করে। বর্তমানে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্য এরা দায়ী করে পশ্চিমি শিক্ষা, আধুনিকতা এবং নারী প্রগতিকে। এই সব তথাকথিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বেরিয়ে এই সব ছাত্র ছাত্রীরা মসজিদ-মাদ্রাসা ছাড়া আর কোথাও কাজ পায়না এবং শেষ পর্যন্ত ইসলামি জঙ্গি দলগুলির সদস্য হয়ে জিহাদি কাজকর্মে জড়িয়ে পড়াই ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়। দেশের সর্বত্র ইসলামি সন্ত্রাসবাদী এবং নাশকতামূলক কাজকর্মে এরাই যুক্ত হয়ে পড়ে বলে দেখে যায়। দু'হাজার পাঁচ সালে দেশ জুড়ে একই সঙ্গে যে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল, তার জন্যে দায়ী ছিল এরাই।
৯/১১ তে আমেরিকার জোড়া টাওয়ার ধ্বংসের পর পাকিস্তানে যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আটকে দেওয়া হয়েছিল, কুয়েতের সেই রিভাইভাল অফ ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি, আল কায়দার সঙ্গে যোগাযোগ থাকার জন্য সারা পৃথিবীতে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া সৌদি আরবের আল হারমেইন ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি সহ আন্তর্জাতিক ইসলামিক এনজিও গুলি এই সমস্ত তথাকথিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে অর্থ সরবরাহ করে আসছিল। এ ব্যাপারে অন্য যে সব ইসলামি এনজিও গুলি নজরে এসেছে সেগুলির মধ্যে আছে আল ইউ এ ই-র আল ফুজেইরা, সৌদি আরবের রাবেতা আল আলম আল ইসলামি এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামি রিলিফ অর্গানাইজেশন।
এই সব সংগঠনের অর্থে মাদ্রাসা ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা মূল্যে খাদ্য, শিক্ষা এবং থাকার ব্যবস্থা করার মত নানা রকমের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। এদের দরিদ্র অভিভাভকদের বোঝানো হয় বাচ্চাদের এই সব মাদ্রাসায় পাঠালে শুধু যে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হবে তা নয়, ইসলামের পুনর্জাগরণে সাহায্য করা হবে।
কিশোর-তরুণদের রীতিমত মগজ ধোলাই করে তাদের জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ায় প্ররোচিত করা কি অসীম ক্ষমতা এই সব সংগঠনগুলির, তা বোঝা যায় ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকার আশকানা অঞ্চলের ঘটনার মধ্যে দিয়ে। গোপন ডেরায় পুলিশি হানার সময় চার বছরের শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এক মহিলা জঙ্গি নিজেকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়েছিল সেই ঘটনায়, যাতে বাংলাদেশে প্রথম কোনও আত্মঘাতী মহিলা জঙ্গির কথা জানা গেল। ওই একই ঘটনায় আত্মসমর্পণের নির্দেশ উপেক্ষা করে একটি ১৪ বছরের কিশোর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকের লড়াই লড়েছিল। এক মহিলা এবং এক কিশোরের এই চরম বেপরোয়া মনোভাব থেকে বোঝা শক্ত নয় কী পর্যায়ের উগ্র মানসিকতার বীজ সঞ্চার করা হয় এদের মধ্যে।