Bangladesh
আত্মগোপনে বঙ্গবন্ধু পরিবার
বিশেষ প্রতিবেদন : পঞ্চাশের দশক থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সার্বক্ষণিক সঙ্গি ছিলেন মোমিনুল হক খোকা। পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে তিনি আগলে রাখেন। এ সময় তিনি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সবাইকে নিয়ে আত্মগোপনে থেকেছেন। মোমিনুল হক খোকার ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল : বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি’ শিরোনামে স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ থেকে সেদিনের ঘটনা তুলে ধরা হলো:
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমি তখন বসে বসে ভাবছি- এখন কোথায় যাব। ভাবীর এক কথা, ‘ভাইডি, তুই আমাদেরকে যেখানে নিয়ে যাবি সেখানেই আমরা যাব।’ আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম ভাবী ও সবাইকে নিয়ে উয়ারিতে আমার শ্বশুরবাড়ি যাব। ভাবী হঠাৎ বল্লেন, ‘ভাইডি, ১৫ নম্বরেই হাসিনার বাসা, ওখানে রেহানা ও জেলী (মরহুম সাইদ হোসেনের কন্যা) আছে। পঁচিশের রাত থেকেইতো ওদের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ নেই। তুই একটু ওদের খোজ নে।’ আমি হাসিনাদের খোঁজে বের হলাম। ওদের বাসায় পৌছে দেখি শুধু রেহানা বসে আছে। আমাকে দেখে রেহানা কাদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমার আব্বা-আম্মার কী হয়েছে, জানেন কাকা? ওরা গেছে তাদের খোঁজ নিতে।’ আমি রেহানাকে নিয়ে ফিরে আসি ক্যাপ্টেন রহমানের বাসায়। সবাইকে নিয়ে উয়ারির উদ্দেশে গাড়ি নিয়ে বের হই।
বাংলা মোটর (তখন পাক মোটর বলা হতো) পর্যন্ত আসতে দেখি শুধু সন্ত্রস্ত মানুষের মিছিল, সবাই যেন দৌড়াচ্ছে। দৃষ্টি তাদের বুড়িগঙ্গার দিকে, যেভাবেই হোক কারফিউর আগে নদীর ওপারে পৌছাতে হবে। মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত গুলির আওয়াজ। সাকুরা হোটেলের কাছে ভস্মীভূত ‘দি পিপল’ পত্রিকার অফিস। আবিদুর রহমানের এই পত্রিকাটি তার সম্পাদনায় প্রকাশের পর থেকেই পূর্ব বাংলার স্বার্থে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। সারা মার্চ মাসব্যাপী জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় প্রকাশের মাধ্যমে বাঙালিদের সংগ্রামী চেতনা জাগরণের পক্ষে পত্রিকাটির ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। এর মধ্যে মগবাজার চৌরাস্তার কাছে পৌছে গেছি। চৌরাস্তার কাছেই থাকতো আমার ভাগ্নী জামাই ইঞ্জিনিয়ার মনসুর এ, টি, জনাব বি এম আব্বাসের ছোট ভাই। ভাবছিলাম মানুষের এই মিছিলের মধ্যে কারফিউর আগে উয়ারি পৌছাতে পারবো না। তাই রাতটা আমার ভাগ্নীর বাসায় থাকবো বলে ঠিক করলাম। কিন্তু চৌরাস্তা পার হতে না হতেই এলো গোলা বর্ষণের আওয়াজ। কোন্ দিক দিয়ে এ গোলার আওয়াজ আসছে তা বুঝতে না পেরে গাড়ি আমি মগবাজার গলিপথে চালিয়ে দেই। টঙ্গি ডাইভারসন রোড তখনও হয়নি। যা হোক, মগবাজারের গলিতে সুপারিনটেনড ইঞ্জিনিয়ার আলী সাহেবের ফ্ল্যাট বাড়ি। বাড়ির এক ফ্ল্যাটে থাকতেন প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবীর, অভিনেতা সিডনী, আরো থাকতেন আলী যাকেরের ভগ্নিপতিসহ আমাদের পরিচিত বেশ কয়েকটি পরিবার। ওখানে পৌছে দেখি ধানমন্ডির মোরশেদ মাহমুদের পরিবার, মগবাজারের খায়ের সাহেবের পরিবারের সবাই সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে সবাই ওখান থেকে ঢাকার বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সবার মুখেই এক আলোচনা, পাকিস্তানি জওয়ানদের বীভৎস অত্যাচারের সব কাহিনী।
কিছুক্ষণ পর এলো মোরশেদ মাহমুদের ছোট ভাই মাহমুদুর রহমান বেনু। তার মুখে শুনতে পেলাম পাকিস্তানি সৈন্যরা ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনার বিধ্বস্ত করে ওখানে একটা সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছে যেখানে লেখা আছে ‘মসজিদ, নামাজ পড়িবার স্থান’। ওখানেই উপস্থিত এক ভদ্রলোক বল্লেন, ‘মূর্খের দল, এবার বাঙালি মুসলমানদেরকে দিয়ে মসজিদ ভাঙ্গাবে’। জানতে পারলাম, ২৬ মার্চ সকালে কমান্ডার মোয়াজ্জেম, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী, তাঁকে তাঁর পরিবারের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানি হায়েনার দল ইকবাল (বর্তমানে জহুরুল হক) হলে বহু ছাত্রসহ নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদেরও গুলি করে হত্যা করেছে। একজন বল্ল, ‘মশারির নিচে ইকবাল হলের দারোয়ান স্ত্রী-পুত্র নিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে আছে’। আরো শুনলাম জগন্নাথ হালের উপস্থিত সব ছাত্রকে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আলমগীর কবীর বল্লেন, অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের কথা, উনি নাকি ছুটে যাচ্ছিলেন মিলিটারিদের দিকে। চিৎকার করছিলেন, ‘আমরা হিন্দু, এখানে সব ছাত্রই হিন্দু’। হয়তো উনি ভেবেছিলেন সংখ্যালঘু হিন্দুর কথা শুনে পাকিস্তান বাহিনী তাদের রক্ষা করবে। দার্শনিক মানুষ বুঝতে পারেননি।
তিনি যাদের কাছে আশ্রয় চাচ্ছেন তারা তাদেরকেই নিশ্চিহ্ন করতে এসেছে। ইউনিভার্সিটির সর্বকালের সর্বজনপরিচিত মধুদা, তাকেও জীবন দিতে হয়েছে। আরো শুনলাম, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে তাঁর পুত্র ও দুই অতিথিসহ নির্মমভাবে হত্যা করেছে পাক সেনাবাহিনী। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, আমরা যে বেঁচে আছি, এটাই তো আশ্চর্য। (চলবে)