Bangladesh
ব্যাটল অব গরিবপুরের ৫০ বছর পূরণ হলো
ঢাকা, নভেম্বর ২১: রবিবার (২১ নভেম্বর) ব্যাটল অব গরিবপুর (গরীবপুরের যুদ্ধের) ৫০ বছর পূর্ণ হলো, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তানের প্রথম সরাসরি সম্পৃক্ততা হিসাবে বিবেচিত। খুলনার বয়রার কাছে গরীবপুরে ট্যাঙ্ক ও যুদ্ধবিমানে সজ্জিত ভারতীয় ও পাকিস্তানি সেনারা মুখোমুখি হয়েছিল।
অসংখ্য রিপোর্ট অনুসারে, ভারতীয় সৈন্যরা তাদের পাকিস্তানি সমকক্ষদের পর্যুদস্ত করেছিল ১৩টি এম২৪ শ্যাফে লাইট ট্যাঙ্ক এবং দুটি এফ-৮৬ স্যাবর (ফাইটার জেট) ধ্বংস করে। মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর দুই কর্মকর্তা ধরা পড়েন।
গরীবপুরের যুদ্ধের অন্যতম প্রধান নায়ক, ব্রিগেডিয়ার বলরাম সিং মেহতা, ভারতের তৎকালীন ৪৫ তম ক্যাভালরি সি স্কোয়াড্রনের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড, এখনও বিশ্বাস করেন যে তারা যুদ্ধে জয়লাভের পর পূর্ব পাকিস্তানের যশোর সেনানিবাসে অগ্রসর হতে পারত গরীবপুর, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে।
‘কিন্তু আমাদের কাছে সেরকম কোনও নির্দেশ ছিল না। যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন আমাদের স্কোয়াড্রন কমান্ডার মেজর দলজিৎ সিং নারাং। নইলে যশোর দখল করে ১৬ ডিসেম্বরের অনেক আগেই হয়তো পশ্চিম পাকিস্তানের পতনের পথ প্রশস্ত করে দিতে পারতো গরিবপুর,’ বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন এই বর্ষীয়ান ভারতীয় সেনানী।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক এবং যুদ্ধবিমান গরীবপুর থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডে এবং মুক্তিবাহিনী শিবিরে গুলি ছুড়েছে, এই সুযোগটি নিয়ে যে ভারতীয় ভূখণ্ড গরীবপুরের ওই এলাকার তিন দিকে রয়েছে।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করার দুই সপ্তাহ আগে, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় গরীবপুর ফ্রন্ট দিয়ে পাল্টা অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
এই যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন কিংবা পরে তা নিয়ে লিখেছেন বা গবেষণা করেছেন, এমন তিন জন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউন নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন:
ব্রিগেডিয়ার বলরাম সিং মেহতা বলেন, ‘আমি তখন ৪৫ ক্যাভালরির স্কোয়াড্রনের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। আমাদের বহরে ছিল রাশিয়ান পিটি-৭৬ ট্যাঙ্ক। ১৪ পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে মিলে ২০ নভেম্বর রাতেই আমরা কাবাডাক নদী পেরিয়ে রাতের আঁধার ও ঘন কুয়াশার আড়াল নিয়ে গরিবপুরের সীমানায় ঢুকে পড়ি। তখন যুদ্ধ শুরু হবে হবে করছে। কথাবার্তা হচ্ছে কানে আসছে। কিন্তু শুরু হয়নি। আমরাই প্রথম ভারতীয় সেনাবহর, যারা আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়েছিল।'
'২১ তারিখ ভোরের আলো ফোটার একটু পর আমাদের ট্যাঙ্কগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক বহরের মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হয়। ওদের সঙ্গে ছিল ১৪টা মার্কিন শ্যাফে ট্যাঙ্ক। যুদ্ধের প্রায় শুরুতেই পাকিস্তানি গোলায় প্রাণ হারান আমাদের স্কোয়াড্রনের কমান্ডার, মেজর দলজিৎ সিং নারাং। ফলে তখন যুদ্ধ পরিচালনার ভার এসে পড়ে আমার ওপর।
'ঠিক তখনই আমার ট্যাঙ্কের কামানও গণ্ডগোল করতে শুরু করে। ওদিকে তিন-তিনটে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক আমাদের ঘিরে ফেলে। প্রায় অলৌকিকভাবে আমরা তিনটি ট্যাঙ্ককেই ধরাশায়ী করতে সফল হই। একটা পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক থেকে ওদের গানার (গোলন্দাজ) যখন ছিটকে বেরিয়ে আসছেন, আমার ট্যাঙ্কের গানার তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে গেলে আমি নিরস্ত করি। পরে তাকে যুদ্ধবন্দি করে আমরা যখন চা-বিস্কুট খাওয়াচ্ছি, তিনি তখনও ধন্যবাদ জানিয়ে যাচ্ছেন।
'আমার ‘বার্নিং শ্যাফিস’ বইতে আমি বিশদে লিখেছি কীভাবে গরিবপুরের যুদ্ধে আমরা জিতেছিলাম। আমি এখনও বিশ্বাস করি, গরিবপুরের সাফল্যের পর আমাদের যদি সোজা যশোর অবধি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে যুদ্ধ হয়তো সেদিনই শেষ হয়ে যেত।’
কর্নেল টি এস সিধু জানান, 'আমি তখন ছিলাম ৪৫ ক্যাভালরির সি স্কোয়াড্রনের অন্যতম ট্রুপ লিডার। গরিবপুরের যুদ্ধে আমার দুটো পা-ই মারাত্মক জখম হয়েছিল। পরে ভাগ্যক্রমে পা দুটো কেটে বাদ দেওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার আঘাতটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং ওই যুদ্ধে ভারত ও মুক্তিবাহিনীর অভাবনীয় সাফল্যই ছিল বিরাট ব্যাপার।'
'পৃথিবীর সামরিক ইতিহাসে এমন নজির আর একটিও নেই—যেখানে দুপক্ষের ১৪টা করে ট্যাঙ্ক মুখোমুখি লড়াই লড়েছে, আর এক পক্ষের সব ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়েছে, অথচ অন্য পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বললেই চলে। গরিবপুরের যুদ্ধে পাকিস্তানের ঠিক সেই শোচনীয় দশাই হয়েছিল। আমাদের শুধু দুটো ট্যাঙ্কের সামান্য ক্ষতি হয়েছিল।
'ওই যুদ্ধের সময়ই পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের গোলা আমাদের ট্যাঙ্কে আছড়ে পড়লে আমার গানার প্রাণ হারান। আমি ও অন্যরা ছিটকে বাইরে এসে হামাগুড়ি দিয়ে নিজেদের পজিশনের দিকে যেতে শুরু করি। পকেটে একটা সাদা রুমাল ছিল, সেটা নাড়তে থাকি হামাগুড়ি দিতে দিতেই—যাতে আমাদের ইনফ্যান্ট্রি ভুল করে আমাদের ওপর গুলি চালিয়ে না বসে, কিন্তু এরইমধ্যে প্রায় শ’দুয়েক স্প্লিন্টার আমার পায়ে ঢুকে যায়, অসম্ভব যন্ত্রণা সয়েই চলতে থাকি। তবু শেষ পর্যন্ত যে আমরা ওই যুদ্ধে জিতেছিলাম, ভাবলে আজও রোমাঞ্চিত হই।'
মেজর জেনারেল অমৃত পাল সিং বলেন, 'গরিবপুরের যুদ্ধে লড়ার সৌভাগ্য না হলেও এই অবিস্মরণীয় লড়াই নিয়ে আমি পরে অনেক পড়াশোনা করেছি। গরিবপুরের যুদ্ধ যেমন মাটিতে লড়া হয়েছিল, তেমনি লড়া হয়েছিল আকাশেও। সেই প্রথম আকাশযুদ্ধে ভূপাতিত হয়েছিল পাকিস্তানের স্যাবর যুদ্ধবিমান। নিচে মাটি থেকে সেই দৃশ্য দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েছিলেন মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনার শত শত সদস্য, স্থানীয় গ্রামবাসী।'
'পাকিস্তানের মোট চারটি যুদ্ধবিমান সেদিন ভূপাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, অন্যদিকে ভারতীয় এয়ারফোর্সের একটি যুদ্ধবিমানেও আঁচড় লাগেনি। এই বিরাট ধাক্কাটা লেগেছিল বলেই বোধহয় পুরো যুদ্ধের সময়টা ওই সেক্টরে পাকিস্তান একবারও আর কোনও এয়ারক্র্যাফট ব্যবহার করেনি।
'ভূপাতিত পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান থেকে ‘বেইল আউট’ করে বেরিয়ে আসা দুজন পাইলট যুদ্ধবন্দি হয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের হাতে। তাদেরই একজন পারভেজ মেহদি কুরেশি সে ঘটনার প্রায় পঁচিশ বছর বাদে ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর প্রধানও হয়েছিলেন।
'১৯৯৬ সালে এয়ার মার্শাল কুরেশি যখন পাকিস্তানি এয়ারফোর্সের প্রধান, তখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন ডোনাল্ড ল্যাজারাস তাকে একটা অভিনন্দনসূচক চিঠি লিখে জানান, ‘আমাদের এর আগে একবারই দেখা হয়েছিল—সেটা কমব্যাট সিচুয়েশনে (যুদ্ধাবস্থায়), আর গরিবপুরের আকাশে’! অপ্রত্যাশিতভাবে সেই চিঠির উত্তরও এসেছিল। এয়ার মার্শাল কুরেশি জবাবে লিখেছিলেন, ‘ভারতীয় বাহিনীর সেই অসাধারণ ফাইটের কথা আজও আমার মনে আছে।’
এদিকে গরীবপুরের যুদ্ধ নিয়ে বলিউডে ছবি তৈরি হচ্ছে।
প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে পিপা এবং তারকা ঈশান খট্টর।
যুদ্ধের চলচ্চিত্রটি ব্রিগেডিয়ার মেহতার দ্য বার্নিং চ্যাফিস বইটির উপর ভিত্তি করে তৈরি।