Column
বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক
এরপর থেকে বাংলাদেশে পর পর দুই সামরিক একনায়কের শাসন চলে- জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তাঁর উত্তরসূরি জেনারেল এইচ এম এরশাদ। এরপর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের পত্নী খালেদা জিয়া। রাজনৈতিক ভাবে দেউলিয়া এই তিনজনেই একুশ বছর ধরে ভারত-বিরোধী বাগাড়ম্বরের মাধ্যমে শাসন চালিয়ে গেছেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান এমন কি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই-এর সক্রিয় সহযোগিতায় বাংলাদেশে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার পর্যন্ত করেছিলেন।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক মুখ থুবড়ে পড়ে। তাঁর সবথেকে ক্ষমতাশালী মন্ত্রীদের মধ্যে একজন স্পর্ধার সঙ্গে পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন যে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আসলে স্বাধীনতাসংগ্রামী এবং বাংলাদেশ সরকারের নৈতিক দায়িত্ব তাদের সাহায্য করা, যে ভাবে ভারত করেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের। এ ভাবে ভারতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে বাংলাদেশকে সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করতে চাওয়া শুধু নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে তিনি বিচ্ছিনতাবাদী আন্দোলনের সংগে তুলনাও করেছেন।
খালেদা জিয়া সরকারের জন্য ইউ এল এফ এ- র মত ভারতীয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি ঢাকায় নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিল। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় দফার শাসনকালে (২০০১-০৬) অবস্থার আরও অবনতি হয়। বাংলাদেশের প্রশাসন যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে তাঁর বড় ছেলে তারিক রহমান ভারতীয় জঙ্গিদের ব্যবহারের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিবহনের পথ খুলে দেন বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ।
চট্টগ্রাম অস্ত্র উদ্ধার মামলা প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশে বি এন পি শাসনকালে (২০০১-০৬) উলফা সহ ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির রমরমা ঘটেছিল। এই সময়কালে আই এস আই -এর সমর্থন এবং সাহায্যপুষ্ট হয়ে উলফা বেপরোয়া ভাবে তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যায় এবং সেই সব কার্যকলাপে প্রশ্রয় দিয়ে ভারতের সুরক্ষাকে বিপন্ন করে তুলেছিল বাংলাদেশ প্রশাসন। আশ্রয় দেওয়া, অনুপ্রবেশ করা এবং বেরিয়ে আসার জন্য সুরক্ষিত পথ করে দেওয়া, বাংলাদেশের বাইরে যাওয়ার জন্য জঙ্গি নেতাদের ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট সরবরাহ করা, অস্ত্র এবং গোলাগুলির যোগান দেওয়া, সেই সব জিনিষ যাতে ঠিকমত পৌছায়, তার জন্য প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করা এবং সেই সব অস্ত্র সড়ক পথে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি উপায়ে বাংলাদেশ সরকার এদের সাহায্য করে গেছে।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান খুন হওয়ার সময় থেকে ১৯৯৬ সাল, যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথমবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন হয়- সেই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে আই এস আই পাকিস্তান জুড়ে এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে এবং ঢাকা আই এস আই -এর কার্যকলাপের নার্ভ সেন্টার হয়ে ওঠে।
ইউ এ ই-র দৈনিক খালিজ টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী আই এস আই-এর ভূতপূর্ব প্রধান জেনারেল আসাদ দুরানি ২০১২ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে প্রকাশ করেন যে উত্তর-পূর্ব ভারতে জঙ্গি কাজকর্মের ব্যয়ভার বহন করে চলেছে আই এস আই এবং তারা ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সংসদীয় নির্বাচনের সময় বি এন পি নেত্রী খালেদা জিয়াকে ৫০ কোটি টাকা দিয়েছে। পরে দুরানি এই বিবৃতি থেকে পিছু হটলেও ঘটনা এটাই যে, ভারতে অস্থিতি তৈরি করতে উলফার নাশকতামূলক কাজকর্মের সঙ্গী হয়ে থেকেছে আই এস আই। কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যকলাপে উস্কানি দেওয়ায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক স্তরে শোরগোল পড়ায় পাকিস্তান অতঃপর বাংলাদেশের মাধ্যমে তাদের ভারতবিরোধী কাজ করতে থাকে।
এই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে ১৯৯৬ সাল থেকে, যখন শেখ হাসিনা প্রথমবারের জন্য সরকার গঠন করেন। বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় জঙ্গিদের তিনি উৎখাত করতে শুরু করেন। শেখ হাসিনার প্রথম দফার শাসনকাল উতসর্গীকৃত হয়েছিল বাংলাদেশকে উন্নয়নের রাস্তায় নিয়ে আসা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে। কিন্তু একই সংগে ভারতের উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলি যাতে সেখানকার অধিবাসীদের কাছে নিরাপদ থাকে, তা-ও সব সময় তাঁর কর্মসূচীতে ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ২০০১ সালে তাঁর দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করতে না পারায় উত্তরপূর্ব ভারতের নিরাপত্তার বিষয়টি ফের আগের জায়গায় চলে যায়।
তবে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা যে সমস্ত সমস্যা ছিল, সেগুলির অনেকগুলিরই সমাধান হয় নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। এগুলির মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ন দু দেশের মধ্যে বহুদিন থেকে বন্ধ হয়ে থাকা রেল যাতায়াত পুনরায় চালু করা এবং সেই পরিষেবাকে শক্তিশালী করা। একই সঙ্গে সড়ক এবং জলপথেও পরিবহন পুনরায় চালু করা হয়। দু' দেশের ছিটমহলগুলির বিনিময় এবং দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধেরও মীমাংসা করা হয়। দু'দেশে অসুবিধাজনক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছিটমহলগুলিকে ভারত অথবা বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং সুনির্দিষ্ট ভাবে সীমান্ত চিহ্নিতকরণের ব্যাপারে ভারতের সংসদ এক বিরল অবস্থান নেয়। সংসদের দু'টি কক্ষই সর্বসম্মতিতে ভোট দিয়ে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিটি অনুমোদন করে এবং এ ভাবে ছিটমহল বণ্টন ও সীমান্তবিরোধ নিরসনে তাদের সম্মতি জানায়।
দু'দেশের মধ্যে বেশিরভাগ দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলির সমাধান হয়ে গেলেও অবশ্য তিস্তার জল বণ্টনের সমস্যাটি এখনও ঝুলেই রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বেশ কয়েক বারই এই ইংগিত দিয়েছেন যে তাঁর সময়কালের মধ্যেই এর সমাধান হয়ে যাবে। তিনি জানিয়েছেন, যে হেতু ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ, সেই হেতু কোনও রাজ্য সরকারকের আপত্তি বা আশংকাকে উপেক্ষা করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়না। তাই তিস্তার জলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বোঝাতে হবে।
ভারত এবং বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমাগত ভাবে এক বিস্ময়কর উন্নতির পথে চলেছে এবং তার ফলে দু'দেশই প্রভূত ভাবে উপকৃত হয়েছে। এই সম্পর্ক এমনই এক অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এবং কূটনীতিকরা প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে সারা বিশ্বে একটি 'রোল মডেল' হিশেবে চিহ্নিত করেছেন। এই দু' দেশের মধ্যে শুধুমাত্র কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হয়নি, জাতীয় নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, লগ্নি, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও শক্তি, মহাকাশ, উন্নয়নমূলক প্রকল্প, সংস্কৃতি এবং দু'দিকের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক- সব দিক দিয়েই বন্ধন গভীরতর হয়েছে। দৃঢ়তর সম্পর্কের লক্ষ্যে এই দুই দেশ গত দু' বছরে প্রায় ১০০ টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। শুধুমাত্র আগের চুক্তিগুলির পুনর্নবীকরণ নয়, স্পেস, সিভিল এবং নিউক্লিয়ার এনার্জি, আই টি এবং ইলেকট্রনিক্স, সাইবার সিকিউরিটি এবং ব্লু ইকনমির মত উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা শুরু করার অঙ্গীকারও করা হয়েছে।
বহু কিছু আছে যা এই দুই দেশকে এক সুতোয় গেঁথেছে- এক ইতিহাস এবং উত্তরাধিকার, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন, গান বাজনা, সাহিত্য ও শিল্পের প্রতি তীব্র আবেগ। একনিষ্ঠ বন্ধু এবং অবিচলিত অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং আই এস আই-এর নির্দেশে এই অঞ্চলে সীমান্তে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালানোর দুষ্ট পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভারতের হাতকে শক্ত করবে।