Column

আতংকের ২১শে অগাস্ট : ১৫তম বার্ষিকী

আতংকের ২১শে অগাস্ট : ১৫তম বার্ষিকী

Bangladesh Live News | @banglalivenews | 27 Aug 2019, 02:31 am
দু'হাজার চার সালের ২১শে অগাস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশের উপর একটি সুসমন্বিত আক্রমণ চালানো হয়েছিল, যাতে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার প্রধান এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান সহ দলের ২৪ জন প্রথম সারির নেতা নিহত হয়েছিলেন। আহতদের সংখ্যা ছিল ৫০০-র বেশি এবং তাদের অনেকেই বাকি জীবনের মত পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন।

এই ঘৃণ্য আক্রমণের ঘটনা যারা ঘটিয়েছিল, তাদের রক্ষা করার জন্য বিএনপি-র চেয়ারপার্সন এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কোনও রকমের চেষ্টার বাকি রাখেন নি। গ্রেনেড আক্রমণের পরে শুরু হল অদ্ভূত ঘটনাপ্রবাহ, যা মাফিয়া রাজত্বের সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামাতের জোট সরকার প্রমাণ করতে চাইল যে, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে  এবং দেশের সরকারকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করতে আওয়ামী লীগ নিজেরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে।

 

২১শে আগস্টের আক্রমণের ঘটনা ঘটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেশের অন্যতম প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেকটরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের প্রধান মেজর জেনারেল (অবঃ) সাদিক হাসান রুমি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে খবরটি জানানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময় খালেদা জিয়া নোয়াখালিতে একটি জনসভায় ছিলেন, তাই সেই দিনেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ফোনেও  পাওয়া যায়নি তাঁকে। তাই তিনি ডিজিএফ আই-এর প্রাক্তন প্রধান তখন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হ্যারিস চৌধুরির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে প্রধানমন্ত্রীকে খবরটি জানিয়ে দিতে বলেন। কোনও আগ্রহ না দেখিয়ে হ্যারিস চৌধুরি মেজর রুমিকে  বলেন, খবর জানিয়ে দেওয়া হবে এবং এই বলেই, বিষয়টি বিশদে বলার আগেই,   হঠাৎ করে  ফোন নামিয়ে রাখেন।

 

তাঁর প্রতিক্রিয়ায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে রুমি এর পর স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী লুতফোজ্জামান বাবরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন (এই ব্যক্তিকে চট্টগ্রাম অস্ত্র পাচার মামলায় মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে)। বাবরও কোনও আগ্রহ না দেখিয়ে রুমির কথা শুনে সহসা ফোন কেটে দেন। এর পরের দিন, ২০০৪ সালের ২২শে অগাস্ট, ঢাকায় খালেদা জিয়ার দপ্তরে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন রুমি, এবং ঘটনার কথা সবিস্তারে জানিয়ে এ ব্যাপারে কারা জড়িত, সে বিষয়ে তদন্ত করার অনুমতি চান। এর উত্তরে খালেদা জিয়া জানান যে, তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে। জেনারেল রুমির কথায় এর অর্থ, "আমার তদন্ত করার দরকার নেই।"

 

"আমি বুঝতে পারলাম যে, প্রধানমন্ত্রী সব কিছুই আগে থেকে জানতেন। তাই আর কথা না বাড়িয়ে আমি তাঁর অফিস ছেড়ে চলে আসি," এক জন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সাক্ষী হিসেবে জেনারেল রুমি বলেছেন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে বেশ বিরক্ত মনে হয়েছিল এবং আক্রমণের ঘটনার কথা বলা এবং তার জন্য তদন্তের অনুমতি চাওয়ায় তিনি রুমিকে প্রায় ভর্তসনাই  করেছিলেন।

 

"কোথা থেকে আপনি এই সব হাস্যকর খবর এনেছেন ? তাজুদ্দিন (আক্রমণের পিছনে অন্যতম মস্তিষ্ক) যদি পাকিস্তান বা অন্য কোথাও যায়, তাতে আপনার মাথা ব্যথার কী আছে ?," জেনারেল রুমির জবানবন্দি অনুযায়ী খালেদা জিয়া বলেছিলেন সেই সময়। শেখ হাসিনার উপর আক্রমণের পিছনে থাকা অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রী মৌলানা তাজুদ্দিন এবং বিএনপি নেতা তথা প্রাক্তন ডেপুটি মিনিস্টার আবদুস সালাম পিন্টুর ভাইকে  নিরাপদে পাকিস্তানে যেতে দেওয়ার অনুমতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই দিয়েছেন, এই খবরের যাথার্থ জেনারেল রুমি জানতে চাওয়াতেই এই প্রতিক্রিয়া ছিল খালেদা জিয়ার।

 

প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান ঢাকার এক ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জানিয়েছেন, সেই সময় ডিজি এফ আই-এর এক জন অফিসার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরি (চট্টগ্রাম অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত), সংস্থার নিয়ম-নীতি লংঘন করে  তারিক রহমান এবং উপ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বাবরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন। আক্রমণের ঘটনার পর আক্রমণকারীদের ফেলে যাওয়া অব্যবহৃত গ্রেনেডগুলি নষ্ট করে ফেলার জন্য তিনি বাবরের কাছ থেকে নির্দেশ পান। 

 

জেনারেল রুমি জানিয়েছেন, এর কয়েক দিন পরে আরও দু'জন ডিজি এফ আই অফিসার তাঁকে জানান যে, মৌলানা তাজুদ্দিনকে নিরাপদে পাকিস্তানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁরা বাবর এবং খালেদা জিয়ার ভ্রাতুষ্পুত্র তথা ব্যক্তিগত সচিত সইফুল ইসলাম ডিউকের মাধ্যমে নির্দেশ পেয়েছেন।

 

ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জেনারেল রুমির এই সাক্ষ্য বাংলা সাপ্তাহিক 'সাপ্তাহিক ২০০" -এ ছাপা হয়েছিল। সেই সময় ওই আক্রমণের ঘটনার বিচার চলছিল। এই বিচারে আদালত থেকে খালেদা জিয়ার বিদেশে পালিয়ে থাকা জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং বিএনপি-র সিনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট তারিক রহমানকে মূল চক্রী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।

 

আদালতের হুকুম অনুযায়ী, তারিক রহমান এবং অন্য ১৯ জন ব্যক্তির তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার চলছে।  আদালতে না আসায় তাদের বিচার এড়াতে চাওয়া ফেরার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। লুতফোজ্জামান বাবর সহ দু'জন তৎকালীন মন্ত্রী, তিন জন প্রাক্তন পুলিশ প্রধান এবং বেশ কয়েক জন প্রাক্তন সামরিক অফিসার, যাঁরা সেই সময় ডিজি এফ আই-তে কর্মরত ছিলেন এবং সেই সঙ্গে বে-আইনি ঘোষিত হুজি এবং তার প্রধান মুফতি আবদুল হান্নান সহ আরও অনেকের এই মামলায় বিচার চলছে।

 

হুজি নেতা এবং বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মৌলানা তাজুদ্দিনকে 'বাদল' নাম নিয়ে একটি জাল পাসপোর্ট করে দেওয়া হয়েছিল। ঐ জাল পাসপোর্ট নিয়ে  ২০০৬ সালের ১০ই অক্টোবর দেশে ছেড়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তাজুদ্দিনকে সাহায্য করেছিলেন খালেদা জিয়ার ভ্রাতুষ্পুত্র সইফুল ইসলাম ডিউক, শ্যালক তথা ডিজি এফ আই-এর অফিসার লেঃ কর্নেল সইফুল ইসলাম এবং অন্য এক জন শীর্ষ অফিসার মেজর জেনারেল এটি এম আমিন। তৎকালীন উপ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লুতফোজ্জামান বাবরের নির্দেশে এই কাজ করা হয়েছিল। এর পিছনে অনুমোদোন ছিল খালেদা জিয়ার। সময়টা ছিল বিএনপি-জামাতের শাসনকালের একেবারে শেষ দিক।

 

পরবর্তীকালে, ২০০৭ সালে, সামরিক সমর্থনে ক্ষমতায় আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন করে এই ঘটনার তদন্ত শুরু করে। মোট ৫২ জন অভিযুক্তের মধ্যে তারিক রহমান এবং হ্যারিস চৌধুরি সহ ১৯ জন পলাতক, তিন জন আই জি পি সহ আট জন জামিনে মুক্ত এবং বাবর সহ বাকিরা এখন জেলে।

 

দলের প্রধান মুফতি হান্নান ( ২০০৪ সালে সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর গ্রেনেড আক্রমণের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে) সহ অন্যান্য হুজি জঙ্গিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, গ্রেনেড আক্রমণের আগে তারা তারিক রহমানের সংগে  দু'টি বৈঠক করেছিল এবং শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালানোর জন্য এই বি এন পি নেতার অনুমতি চেয়েছিল। এই অভিযানের জন্য সব রকমের সাহায্য দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন তারিক রহমান।

 

যে গোপন বৈঠকে শেখ হাসিনার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য হুজি জঙ্গিদের নির্দেশ দেওয়া হয়, সেখানে তারিক রহমানের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুতফোজ্জামাণ বাবর, হ্যারিস চৌধুরি, জামাতের সেক্রেটারি জেনা্রেল এবং তৎকালীন সমাজ কল্যান মন্ত্রী আলি আহসান মহম্মদ মোজাহিদ (যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি হয়েছে) এবং এন এস আই-এর ডিরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরি। বৈঠকটি হয়েছিল হাওয়া ভবনে।

 

সুতরাং এ'ব্যাপারটি স্পষ্ট যে, ২১শে অগাস্টের হত্যালীলার নকশা তৈরি করা হয়েছিল হাওয়া ভবনে, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত যা ছিল বি এন পি-নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্র। এ সব কিছুর পিছনে মূল ব্যক্তি ছিলেন বি এন পি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারিক রহমান।

সর্বশেষ শিরোনাম

বাংলাদেশে পশ্চিমের ‘গণতান্ত্রিক বিতর্কের’ শূন্যতা Tue, Jan 02 2024

হাসিনার ১৫ বছর: আঞ্চলিক সহযোগিতা ও প্রবৃদ্ধির একটি অনুকরণীয় গল্প Thu, Dec 07 2023

বাংলাদেশ: পাকিস্তানের ছায়া থেকে পরিপক্ক গণতান্ত্রিক দেশ Fri, Dec 01 2023

ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মতন্ত্র: বাংলাদেশ - এবং পশ্চিম - হুমকির মুখে Thu, Nov 16 2023

সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের সূচক - বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের তুলনা Tue, Jan 17 2023

বাংলাদেশে বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতি - ব্যাপক দুর্নীতি ও উগ্র ইসলামবাদ Sat, Nov 19 2022

বিডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনের বাইরে বাংলাদেশ Wed, Dec 08 2021

Manipulating institutions: The Chinese Way in Bangladesh Sat, Dec 04 2021

শিল্পদ্রব্যের গুনমাণ: কোথায় চীনের বিশ্বাসযোগ্যতা Tue, Sep 15 2020

চিন থেকে সাবধান হওয়ার সময় এখন Mon, Aug 31 2020