Muktijudho
বঙ্গবন্ধু বিদ্রোহী নেতা হতে না চাননি: ধরা দেন পাক বাহিনীর কাছে
ঢাকা, ২৩ মার্চ ২০২৩ : পঞ্চাশের দশক থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সার্বক্ষণিক সঙ্গি ছিলেন মোমিনুল হক খোকা। তিনি একাধারে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর গাড়িচালক, ব্যক্তিগত সহকারি এবং আপন ফুফাতো ভাই। মোমিনুল হক কেবল গাড়িটি চালাতেন না, তিনি ওই গাড়ির মালিকও ছিলেন। তিন দশকেরও বেশি সময় বঙ্গবন্ধুর সান্বিধ্যে থাকার সুবাদে তিনি ছিলেন পূর্বাপর অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষী। পচাত্তর পরবর্তী সময়ে তিনি ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল : বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি’ শিরোনামে একটি স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। এর আগে গত ৭ মার্চ তার ওই গ্রন্থকে ভিত্তি করে একাত্তরে ৭ মার্চের ঘটনাবলী নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। আজ থাকছে অবিকল গ্রন্থকারের ভাষায় ৭ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা:
৭ মার্চের পর থেকেই শুরু হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সর্বাত্মক অসহযোগিতা, যার ফলে সারা দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি, আধা-সরকারি দপ্তর, শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ হয়ে যায়। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেদিন যে অসহযোগ আন্দোলন সূচিত হয়েছিল বিশ্বের ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেই।
অসহযোগ আন্দোলনকালে চলে গণমানুষের অসংখ্য দৃপ্ত মিছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কঠিন শপথ নিয়ে দিনভর প্রতিটি মিছিল এগিয়ে যায়, লক্ষ্য তাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আর সেখান থেকে ৩২ নম্বর রোড ধানমন্ডি।
মিছিলে যোগদানকারীদের মধ্যে ছিল ছাত্রছাত্রী, বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী আর সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যবৃন্দ। সংগ্রামী চেতনার অতুল বৈভবে মহিমান্বিত এইসব মিছিলে প্রতিটি সদস্য উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে একচ্ছত্র নেতার ঘোষণায়, ‘যে জাতি রক্ত দিতে জানে, কোনো শক্তি তাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সাত কোটি মানুষের মুক্তি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবেই চলবে।’
সারা দেশের সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থা বা অত্যাবশ্যকীয় সেবাদানমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে যেন অহেতুক বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় তার জন্য ৩২ নম্বর রোড থেকে বিভিন্ন নির্দেশ জারি করা হতে থাকে। কার্যত গোটা পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকার্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে এবং তা চলতে থাকে সুষ্ঠুরূপে।
বিবিসি নৈশকালীন সংবাদে এই সংবাদটি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে যে শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেছেন। বস্তুত ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আর দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শে যেভাবে সারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছিল যা ছিল এক আদর্শ সিভিল সোসাইটির উদাহরণ। এতদিন পর আমার মনে হয় স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও যদি দেশ ওই একইভাবে চলতে থাকতো তা হলে আজ বাংলাদেশের চেহারা ভিন্নরূপ হতো।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকাকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সামরিক-বেসামরিক পরামর্শদাতাদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা পৌঁছান। অবশ্য ইয়াহিয়া খানের আগমনের আগে থেকেই গোপনে বেসামরিক পোশাকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ঢাকা পাঠানো শুরু হয়েছিল। দু’এক দিনের মধ্যেই শুরু হয় ইয়াহিয়া-মুজিব’ আলোচনা। শুনেছিলাম ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে ‘মুকুটহীন সম্রাট’ বলে সম্বোধন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন ড. কামাল হোসেনসহ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ। আমি আমার গাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেতাম কালো ফ্ল্যাগ লাগিয়ে। আসতে-যেতে যে সামান্য কথা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে শুনতে পেতাম তাতে তেমন আশান্বিত হওয়ার মতো কিছু না থাকলেও সম্পূর্ণ নিরাশ হওয়ারও কিছু থাকতো না। আমার মতো সারা দেশ অধীর আগ্রহে এই আলোচনার দিকে তাকিয়েছিল।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে এলেন পিপল্স পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। আজ মনে হয়, যদি কোনো একজন ব্যক্তিকে পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য দায়ী করা যায়, তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টো । এই লোকটি নির্বাচনের পর হতেই এমন সব কথা বলে আসছিলেন, যার একটা ব্যাখ্যাই হতে পারে, তা হচ্ছে যেভাবেই হোক পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
আলোচনা যতো দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছিল জনসাধারণের কাছে ততোই এ আলোচনা যে ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে প্রতারণামূলক ও প্রহসনমূলক তা পরিষ্কার হয়ে আসছিল। এছাড়া খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে আলোচনার আড়ালে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বিমানে ও জাহাজে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার সৈন্য ও ভারি অস্ত্রশস্ত্র আনা হচ্ছে। আরো শুনা যায় সামরিক জাহাজ ‘সোয়াতে’ করে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও সেনাদের নিয়ে আসা হয়েছে। এ সব খবরে সাধারণ মানুষ স্বভাবতই শঙ্কিত বোধ করে।
এদিকে ক্যান্টমেন্টের এমন খবর ছিল না, যা বঙ্গবন্ধু জানতেন না। বাঙালি সেনা অফিসাররা তাৎক্ষণিকভাবে সব খবর বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দিতেন। এমনকি ২৫ ডিসেম্বরের ক্রাক ডাউনের খবর আগে থেকেই জানতেন । এ কারণে সকল আওয়ামী লীগ নেতা এবং দর্শনপ্রার্থী সবইকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে ২৫ মার্চ রাত ১২ টায় বাসা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজে পাক আর্মিও কাছে ধরা দেন। সবার অুরোধ সত্ত্বেও তিনি সপরিবারে ধানমন্ডির বাসভবনে থেকে যান। এ ব্যাপারে তার যুক্ত ছিল তিনি বিদ্রোহী নেতা হতে চান না। কেননা পাকিস্তানের সিংহভাগ মানুষ তাকে তাদের নেতা নির্বাচিত করেছে। দ্বিতীয়ত: তিনি ধরা না দিলে তার অনুসন্ধানে সারাদেশে তান্ডব চালাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। (চলবে)।