Muktijudho
মার্চে বারবার বাসা বদল করেন বঙ্গবন্ধুর পরিবার
Special Report: Mominul Haque Khoka was the constant companion of Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman from the fifties. He kept Bangabandhu's family safe until he was captured by the Pakistani forces in 1971. During this time, he stayed in hiding with Bangabandhu's family in different places of the capital. Below is a part of the events of that time from Mominul Haque Khokar's memorial book titled 'Astarage Smriti Samujjwal : Bangabandhu, Tar Poribar o Ami':
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অবশেষে একদিন সকালে বের হলাম বাসার খোঁজ করতে। মালিবাগ এলাকায় গিয়ে দেখি কয়েকটি বাড়ির সামনে টু-লেট ঝোলানো আছে। একটা বাসা পছন্দ হলো। উয়ারিতে ফিরে গিয়ে ভাবী, সহধর্মিণী ও বাচ্চাদের গাড়িতে উঠিয়ে আবার এলাম বাসা দেখতে। কিন্তু বাসার কাছে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই বহু লোক আমাদের গাড়ির পাশে ভিড় জমালো। মনে হলো যেন বহুদিন এসব লোক কোনো গাড়ি দেখেনি। ভাবী তখন বল্লেন, ‘ভাডি, অসম্ভব, এখানে গাড়ি থেকেইতো নামা যাবে না, আর নেমে পড়ার পর কি হবে বুঝতেই পারছি। তুই জলদি গাড়ি নিয়ে অন্য কোথাও চল্।’
আমি উপায়ান্তর না দেখে গাড়ি ঘুরিয়ে চৌধুরী পাড়ার দিকে যেতে শুরু করলাম। এদিকে বেলা শেষ হয়ে আসছে। কিছু পরেই শুরু হয়ে যাবে মিলিটারির পদচারণা।
আমি বল্লাম ভাবীকে, ‘চলুন, আজকের মত উয়ারি ফিরে যাই।’ ভাবী বল্লেন, ‘না, যেকোনো একটা খালি জায়গা বের কর, দরকার হলে গাড়িতেই রাত কাটিয়ে দেব সবাই। আচ্ছা তুই ভেবে দেখ্তো তোর মিঞাভাইর অবস্থা, তাকে ওরা কিভাবে রেখেছে একমাত্র খোদাই জানেন।'
সন্ধ্যা হয়ে গেল, চারিদিকে ভৌতিক নীরবতা। কি করি? হঠাৎ দেখি সামনে একটি দোতলা নির্জন পরিত্যক্ত বাড়ি। দেয়ালগুলির প্লাস্টারও সব খসে পড়েছে। আর কিছু না ভেবে গাড়ি বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। ভাবী ও বাচ্চাদেরকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে আমি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলাম। একতলাটি খালি, দোতলাতেও নেই কোনো সাড়া-শব্দ। কিন্তু কেন যেন মনে হলো দোতলা জনপ্রাণী শূন্য নয়। সাহস করে দোতলার একটি কামরাতে ঢুকে পড়ি। এওকী সম্ভব? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি, ঘটনার একি অদ্ভুত সমাপন! দেখি ওই কামরাতে পলি (মরহুম সাইদ হোসেনের জ্যেষ্ঠা কন্যা) আর তার স্বামী ওদুদ জবুথবু হয়ে বসে আছে।
পলি আমাকে দেখে মামা বলে ছুটে এলো। আমি ওকে সামলিয়ে নিচে এসে ভাবী ও বাচ্চাদেরকে নিয়ে এলাম। তারপর শুরু হলো পলি ও ভাবীর অঝোর কান্না। চারিদিকে অখণ্ড গা ছমছমে নীরবতা। আর ভেতরে এই দুই রমণীর বুক চেপে কান্না। আমি ও ওদুদ নীরব, সান্তনার বাণীও যেন হারিয়ে গেছে।
অভুক্ত রাসেল, পরিবারের সবাই, কিন্তু কে যাবে বাইরে জীবন বলি দিতে। সেই পরিত্যক্ত বাসার পরিত্যক্ত কক্ষে সবাইকে নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হলো। বিনিদ্র রজনী কাটানোর ফাকে ফাকে ভাবীর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম সকল কষ্টেরওতো শেষ আছে। এই তিমির রজনী পার হয়ে যেতে হবে আমাদের সবাইকে, কিন্তু সেটা কতদূর কে জানে!
পরদিন ভোরে ভাবীদের রেখে আমি একাই বেরুলাম বাড়ির খোঁজে। চৌধুরী পাড়াতেই একটা সুন্দর দোতলা বাড়ি দেখতে পেলাম। বাড়িটা ভাড়া দেয়া হবে। বাড়ির মালিক এক মহিলা। বিস্মিত হলাম দেখে যে এই মহিলা আর কেউ নন, সেই কমলাপুর জাহাজ বাড়ির মালিক যার বাসা ১৯৫৫ সনের প্রথমদিকে ভাড়া নিয়েছিলাম আমি ও আমার বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার গিয়াসুদ্দিন। মাতৃসমা এই মহিলা আমাকে বরাবর স্নেহ করতেন। তাঁর তিন ছেলের দুই জন দলু ও বদর, আর দুই মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। দুই মেয়ে হেনা ও মনু। দলু এখন বিলেতে প্রবাসী আর বদর ১৯৭৭ সনে সংঘটিত অভুথানে বিমান সেনাদের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পাওয়া গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত)।
হেনা তার স্বামীর সঙ্গে প্রবাসী আর মনু ডাক্তার হয়ে এখন কোথায় আছেন জানি না। যাক, যে কথা বলছিলাম, মহিলা আমাকে দেখে অবাক হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কার জন্য বাড়ি ভাড়া নেব। আমি বুঝিয়ে বলতেই তিনি রাজি হলেন। আমি খুশি মনে এসে সবাইকে নিয়ে ওই বাসাতে গিয়ে উঠলাম। পলি তখন অন্তঃসত্ত্বা, সেও আমাদের সঙ্গে রইলো।
চৌধুরীপাড়ার বাসাতে স্থির হয়ে বসতে না বসতেই ভাবী আবার অস্থির হয়ে উঠলেন ‘ভাডি, হাসুর কোনো খবর পেলাম না, একটু খোঁজ নিয়ে দেখ না, অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটা আমার কিভাবে আছে, কোথায় আছে’? খোজ নেয়া কি সহজ কথা, কোথায় যাব আমি খোজ নিতে? উয়ারিতে আবার আমার শ্যালকের শরণাপন্ন হলাম। আমার শ্যালক হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদের অফিসে গিয়ে জানতে পারলো ওয়াজেদ তার স্ত্রী ও শালীকে নিয়ে এক সহকর্মীর বাসায় আছে, চৌধুরীপাড়াতে তাদের বাসস্থানের ঠিকানা।
ভাবীকে বলে আমি একাই গেলাম তাদের খোঁজে। চৌধুরীপাড়াতে এক বাসাতে উঠেছিল তারা। ওখান থেকেই ড. ওয়াজেদ নিয়মিত অফিসে হাজিরা দিচ্ছে। আমি ওই বাসায় যেতেই ওয়াজেদ বেরিয়ে এলো। সঙ্গে তার বন্ধু ও সহকর্মী মোজাম্মেল সাহেব। ওয়াজেদতো আমাকে দেখে বেজায় খাপ্পা। আমি কিছু বলার আগেই সে চিৎকার করে উঠলো ‘কাকা, আপনি কোন্ বুদ্ধিতে এখানে এসেছেন? আপনি জানেন না, আপনার পেছনে পাক সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনি জলদি এখান থেকে সরে পড়ুন।' আমি শুধু বল্লাম, ‘হাসুর শরীর ভালো না, ভাবী তাই খোঁজ নিতে বলছিলেন। আচ্ছা ঠিক আছে, ভালো থেকো।’ বিষন্ন মন নিয়ে গাড়িতে এসে বসি। (চলবে)