South Asia
মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত নেতা অং সান সু চিকে চার বছরের কারাদণ্ড; বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ
নেপিদাও, ডিসেম্বর ৬: সামরিক শাসিত মিয়ানমারের একটি আদালত ভিন্নমত উস্কে দেওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইনের অধীনে কোভিড বিধিনিষেধ লঙ্ঘনের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত নেতা অং সান সু চিকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।
সু চির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক রায়ে এটি প্রথম যা সর্বোচ্চ ১০০ বছরেরও বেশি কারাদণ্ড হতে পারে।
মিয়ানমারের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) দলের সহযোগী উইন মিন্টকেও একই অভিযোগে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
রাজধানী নেপিদাওতে অনুষ্ঠিত এই বিচার গণমাধ্যমের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং সামরিক বাহিনী সু চির আইনজীবীদের গণমাধ্যম ও জনগণের সাথে যোগাযোগ করতে নিষেধ করেছে বলে জানা গেছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের পতনের পর থেকে অং সান সু চি এবং অন্যান্য বেসামরিক নেতারা আটক রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে। এই মামলাকে ব্যাপকভাবে 'অন্যায়' বলে নিন্দা জানানো হয়েছে। অন্যদিকে সু চি তার বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগের সবকটিই অস্বীকার করেছেন।
এই উন্নয়ন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান সম্পন্ন সূত্র দাবি করেছে যে সু চি এবং উইন মিন্টকে এখনো কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে না, এবং তাদের নেপিডোর "অজ্ঞাত" অবস্থান (গুলি) থেকে অন্যান্য অভিযোগের মুখোমুখি হতে হবে যেখানে তাদের রাখা হয়েছে।
সূত্র জানায়, অং সান সু চি আগামী ১৪ ডিসেম্বর আদালতে হাজির হবেন। টেলিকম আইনের আওতায় অবৈধ ওয়াকি-টকি রাখার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে।
৭৬ বছর বয়সী নোবেল বিজয়ী সু চিকে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ, সরকারী গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘন এবং টেলিকম আইন সহ বিভিন্ন মামলা করা হয়েছে, যা তাকে পুরোপুরি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ের জন্য কারাগারে প্রেরণ করতে পারে।
অং সান সু চির সমর্থকরা দাবি করেছেন যে এই নেতার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ভিত্তিহীন ফৌজদারি মামলা তৈরি করা হয়েছে যাতে তার রাজনৈতিক জীবন শেষ হয় এবং সামরিক শাসকরা ক্ষমতা সংহত করতে পারে।
মিয়ানমারের নির্বাসিত বিরোধী দল জাতীয় ঐক্য সরকারের উপমন্ত্রী মাও হতুন অং এই রায়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, দেশের ভাঙা বিচার ব্যবস্থা থেকে কিছুই আশা করা যায় না
সু চির কারাদন্ডে বিশ্ব প্রতিক্রিয়া:
যুক্তরাজ্যের (যুক্তরাজ্য) পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রাস টুইট করেছেন, "অং সান সু চির শাস্তি মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র দমনের আরেকটি ভয়াবহ প্রচেষ্টা।"
ট্রাস টুইটারে লিখেছেন, "যুক্তরাজ্য শাসকদের রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি, সংলাপে লিপ্ত হওয়ার এবং গণতন্ত্রে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।"
সু চির বিরুদ্ধে রায় সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন: "মিয়ানমারের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি যে মিয়ানমারের সব দল ও দল দেশ ও জাতির দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ থেকে এগিয়ে যাবে, সংবিধান ও আইনি কাঠামোর অধীনে তাদের মতপার্থক্য দূর করবে, এবং মায়ানমারের জাতীয় অবস্থার সাথে খাপ খাবে এমন কঠোর গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখুন।"
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট এক বিবৃতিতে সু চিকে দোষী সাব্যস্ত ও শাস্তি প্রদানের বিষয়ে বলেন, "সামরিক নিয়ন্ত্রিত আদালতে গোপন ীয় বিচারের পর স্টেট কাউন্সেলরকে দোষী সাব্যস্ত করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছাড়া আর কিছুই নয়।"
ব্যাচেলেট বলেন, "এটি কেবল তার স্বাধীনতাকে যথেচ্ছভাবে অস্বীকার করার বিষয় নয়- এটি রাজনৈতিক আলোচনার আরেকটি দরজা বন্ধ করে দেয়।" তিনি আরও বলেন, "সামরিক বাহিনী সকল রাজনৈতিক বিরোধিতা দূর করার জন্য আদালতকে সহায়ক করার চেষ্টা করছে, কিন্তু এই মামলাগুলো অভ্যুত্থান এবং সামরিক শাসনের অবৈধতার জন্য আইনগত আবরণ প্রদান করতে পারে না।"
জাতিসংঘের হাই কমিশনার বলেন, "অং সান সু চির বিরুদ্ধে এই রায় অভ্যুত্থানপ্রত্যাখ্যানকে আরও গভীর করবে এবং যখন প্রয়োজন তা হচ্ছে আলোচনা এবং এই সংকটের শান্তিপূর্ণ, রাজনৈতিক নিষ্পত্তি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইইউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই রায়ের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য এটি আরেকটি বড় ধাক্কা।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "ইইউ অভ্যুত্থানের পর থেকে সকল রাজনৈতিক বন্দীর পাশাপাশি যথেচ্ছভাবে আটক সকল বন্দীদের অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তির জন্য তাদের জরুরী আহ্বান ের পুনরাবৃত্তি করেছে।"
লন্ডনভিত্তিক বৈশ্বিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, "এই সব ভুয়া অভিযোগে অং সান সু চিকে যে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তা মিয়ানমারের সকল বিরোধিতা দূর করতে এবং স্বাধীনতা রদ করার জন্য সামরিক বাহিনীর দৃঢ় সংকল্পের সর্বশেষ উদাহরণ।"
মিয়ানমারে সু চির বিচ্যুতি:
বোগিওক অং সানের কন্যা অং সান সু চি - ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক- ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে পূর্ববর্তী সামরিক সরকারের অধীনে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দী অবস্থায় কাটিয়েছেন।
সু চি কে ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয় তার কাজের জন্য যাতে তিনি গণতন্ত্রকে "সামরিক শাসিত" মায়ানমারে নিয়ে আসেন।
২০১০ সালে গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সু চি তার ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)কে ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিপুল জয় এনে দেন এবং মায়ানমারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বেসামরিক সরকার গঠন করেন।
বিদেশী জাতীয় শিশুদের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়া থেকে বিরত রেখে প্রবীণ নেতাকে নিজেই দেশের রাষ্ট্রপতি হতে বাধা দেওয়া হয়, যদিও তাকে ব্যাপকভাবে মায়ানমারের প্রকৃত শাসক হিসাবে গণ্য করা হত।
২০১৭ সালে যে ভাবে রোহিঙ্গা সংকট ের সূত্রপাত হয়েছিল তাতে তার বৈশ্বিক খ্যাতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মিয়ানমারের আইকন টি অনুগ্রহ থেকে পড়ে যায় এবং ২০১৯ সালে সু চিকে গণহত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে তার দেশকে রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘের (জাতিসংঘ) আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) উপস্থিত হতে হয়েছিল।
সামরিক বাহিনী সু চির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করার পর থেকে মিয়ানমার ১০ মাস ধরে অস্থিরতা সহ্য করছে। এর ফলে গণতন্ত্র নিয়ে দেশটির এক দশক ের পুরনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবসান ঘটেছে। অন্যদিকে সামরিক দখলের পর থেকে দেশব্যাপী সহিংসতায় ১,৩০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে।