South Asia
গিলগিট-বালতিস্তানের রাষ্ট্রীয় নকশা বদলে দেওয়ার পথে পাকিস্তান
ইসলামাবাদ, জানুয়ারী ২৮: ২০২১ সালে পৌঁছেও অধিকৃত গিলগিট-বালতিস্তানে সেখানকার মানুষের নাগরিক অধিকার হরণ করে চীনের প্রেসিডেন্ট শিন জিনপিং-এর সম্প্রসারণবাদী নীতির অনুসরণ করে চলেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। মানুষের সঙ্গে কার্যত প্রতারণা করে পিছনের দরজা দিয়ে এই অঞ্চলের সামরিকীকরণ করছেন তিনি। এর ফলে গোটা পাকিস্তান জুড়ে দ্রুত বাড়ছে চীনা প্রভাব।
তবে এই দু'জনের ক্ষতিকর অভিসন্ধি ধরে ফেলতে শুরু করেছেন মানুষ। পাকিস্তান সরকারের ফ্রন্টিয়ার কোর (এফসি) মোতায়েনের মেয়াদ আরও তিন বছরের জন্য বাড়ানোর সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন গিলগিট-বালতিস্তানের সাধারণ মানুষ। স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ কেড়ে নেওয়ার জন্য এঁরা আগে থেকেই বিরূপ ছিলেন ইমরান সরকারের প্রতি।
এর আগে, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে ইমরান খান গিলগিট-বালতিস্তানে এসে দুটি আন্তর্জাতিক উদ্যান তৈরি করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ছিলেন সেখানকার মানুষদের।
ইমরান বলেছিলেন, এর ফলে স্থানীয়দের জন্য ৫০০০ নতুন কর্মসংস্থান হবে। আসলে এ কথা বলে তিনি গিলগিট-বালতিস্তান থেকে ৩,৬০০ স্কোয়ার কিমি জমি কেড়ে নিতে চেয়েছেন।
সম্প্রতি ২৪০০ সদস্যের ফ্রন্টিয়ার কোরকে গিলগিট-বালতিস্তানের ডিপার্টমেন্ট অফ ফরেস্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়ায় স্থানীয় মানুষদের কাছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দ্যেশ্য প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।
এই ফ্রন্টিয়ার কোরই এর আগে বালোচ আন্দোলনকারীদের দমন এবং হত্যা করে সরকারের কাছে তার আনুগত্যের প্রমাণ রেখেছে। যে বর্বরতা তারা বালোচিস্তানে চালিয়েছে, তা সারা পৃথিবীকে দেখিয়েছে কী ভাবে একটি রাষ্ট্র তার 'নিজের' মানুষজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদের ন্যায্য দাবিগুলিকে দমন করার চেষ্টা করে।
এটি পাকিস্তান সরকারের অত্যাচারের আরেকটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আগামী তিন বছর দখলকৃত গিলগিট-বালতিস্তানে থাকবে পাকিস্তানের প্যারা মিলিটারি বাহিনী এফ সি। এই সব প্যারা মিলিটারি বাহিনী গিলগিট-বালতিস্তানের পার্ক, রাস্তা এবং বিভিন্ন সড়কে মোতায়েন করা হবে। আর এর মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার উপনিবেশবাদ অত্যাচারকে আরো গভীর করছে।
গিলগিট-বালতিস্তানের উপর ইসলামাবাদের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। এর ফলেই সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী অ্যাকশন কমিটি (এএসি)-জিবি সরকারের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমেছে।
গিলগিট-বালতিস্তানের সংহতি নাশ করে তাকে চূর্ন বিচূর্ন করার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে এএসি। যে রকম সন্দেহজনক উপায়ে অবৈধ ভাবে গিলগিট-বালতিস্তানকে পাকিস্তানের পঞ্চম প্রদেশের মর্যাদা দেওয়া হল, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে সন্দেহের বাতাবরন তৈরি হয়েছিল। এরপরে আবার ওই অঞ্চলে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির ফলে পাকিস্তানের অনুপ্রবেশের ব্যাপারে সেই সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণনত হয়েছে।
নির্বাচনে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন পিটিআই-এর রিগিং-এর পর যে হিংসাত্মক প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল, তা পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের অবিশ্বাস এবং ক্রোধেরই প্রকাশ।
অন্যদিকে, বহু দশকের মধ্যে চরমতম অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হওয়া পাকিস্তান চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর নৌকোতে চড়ে বসেছে। কিন্তু ভুলে গেছে যে এই নৌকো চড়ার মূল্য দেশের সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে চোকাতে হতে পারে। গিলগিট-বালতিস্তানের মধ্যে দিয়ে চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোরের (সিপিইসি) পিছনে চীন ইতিমধ্যেই প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, যদিও এই প্রকল্পের সিংহভাগই নিজেদের হাতে রেখেছে তারা।
পাকিস্তানের সব সরকারের আমলেই প্রান্তিক হিসেবে থেকে গেছেন গিলগিট-বালতিস্তানের জনসাধারণ। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধশালী এই অঞ্চলটি সব সময়েই ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিকদের শোষণের নিশানায় থেকেছে। হুহু করে বেড়ে ওঠা কাঠ মাফিয়াদের দৌরাত্মে ব্যাপক ভাবে গাছ নির্মূল হয়েছে গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চল আর চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবেশ। বৈধ, অবৈধ নানা সুযোগোই করে দেওয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এই দৌরাত্ম চালানোর জন্য।
অতি সম্প্রতি গিলগিট-বালতিস্তানের জনগণের জীবনের উপর চরম আঘাত নামিয়ে এনেছে সিপিইসি। এই প্রকল্পের ফলে সাধারণ স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান তো হয়ইনি, বরং কারাকোরাম হাইওয়ে (কেকেএইচ) গড়ে তোলার জন্য এঁদের অনেককেই নিজেদের জায়গা জমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য উচ্ছেদের নোটিশ ধরানো হয়েছে। চীনের অবৈধভাবে অধিকৃত জিনজিয়াং-এর সঙ্গে পাকিস্তানের অধিকৃত গিলগিট-বালতিস্তানের মধ্যে বৃহত সংযোগকারী রাস্তা এই কেকেএইচ।
গিলগিট-বালতিস্তানের জনগণের দুর্দশার এখানেই শেষ নয়। প্রতিদিনই নানা ধরনের হেনস্থা, বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তাঁরা। অঞ্চলের ছাত্রদের বৃত্তির সু্যোগ না দেওয়া থেকে শুরু করে তালিকাটি দীর্ঘ। গিলগিট-বালতিস্তানে জলবিদ্যুতের সব থেকে বড় সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলে বিদ্যুতের জোগান অতি সামান্য। গিলিগিট শহরে ১৮ থেকে ২১ ঘণ্টার লোড শেডিং হয়। এ ছাড়া আস্টোরে জেলার ১ হাজার ৫০০ বাড়িতে এখনো বিদ্যুৎই পৌঁছায়নি। জনবিন্যাস বদলে যাওয়ার আশংকাও প্রবল এই অঞ্চলে।
এছাড়া গিলগিট-বালতিস্তানের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসকও পাওয়া যায় না। কোনো হাসপাতালেই করোনা রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা নেই। সামান্য অ্যাপেন্ডিক্সের অপারেশন করার মতো চিকিৎসকও নেই গিলগিট-বালতিস্তানে।
গিলগিট-বালতিস্তানকে পাকিস্তানের প্রদেশ বানাতে চাওয়া জাতিসংঘের রেজুলেশনের পরিপন্থী। জাতিসংঘের রেজুলেশনে অনুযায়ী গিলগিট-বালতিস্তান নিয়ে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত সকল পাকিস্তানের সেনা এবং বহিরাগত বাসিন্দাদের সরিয়ে ফেলার আহ্বান জানান হয়েছিল।
এই মূহুর্তে গিলগিট-বালতিস্তানের মানুষ সব থেকে বড় যে সমস্যার মুখোমুখি, তা অঞ্চলের ব্যাপক সামরিকীকরণের ফলে ব্যাপক কর্মচ্যুতি। পাকিস্তান সরকার বর্তমানে ওই অঞ্চলে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতির বাইরে আর কিছু চিন্তা করতে রাজি নয়। স্থানীয় মানুষের প্রতি এতটাই অসংবেদনশীল এই সরকার। পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে এফ সি প্যারামিলিটারি বাহিনীর হাতে বালোচিস্তানের মত এখানেও আরও একটি গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার আগেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলির হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।