South Asia
আফগান নারীদের সমস্ত অধিকারই কেড়ে নিচ্ছে তালেবান
কাবুল, ফেব্রুয়ারী ৫: আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখলে করায় ব্যাপক মানবাধিকার হরণ, বিশেষ করে নারীদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার যে আশঙ্কা দানা বেঁধেছিল সারা বিশ্বে, বিশেষত আফগানিস্তানে, তা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। যদিও কৌশলগত কারণে তালেবান এমন আশংকা উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, তাদের প্রথম দফার শাসনকালের কথা বিস্মৃত না হওয়া মানুষ তাতে মোটেই আশ্বস্ত হন নি।
প্রথম দিকে খানিকটা সংযত থাকলেও তালেবান তাদের চরম মৌলবাদী পথে প্রথমে ধীরে, তারপরে দ্রুত হেঁটে আফগান নারীদের যাবতীয় অধিকার এবং সম্মান দলে পিষে নিজেদের কর্মসূচী ভালভাবেই রূপায়ন করে চলেছে। তারা আরও একবার প্রমাণ করল যে কয়লা শতবার ধুলেও রঙ পালটায়না।
গত বছরের অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি ক্ষমতায় আসার পর থেকে তালিবান বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যেগুলির অধিকাংশই নারীদের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ছাড়া অন্য কোথাও আফগান মেয়েদের কাজ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সিক্সথ গ্রেডের বেশি তারা পড়াশোনাও করতে পারবেনা বলে ফতোয়া জারি করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে মেয়েদের হিজাব পরা।
বিভিন্ন সংবাদসূত্র থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, গত ২৬ ডিসেম্বর একটি নির্দেশনা জারি করে তালেবান সরকার ফতোয়া দিয়েছে যে, আফগানিস্তানের নারীরা ৭২ কিলোমিটারের (৪৫ মাইল) চেয়ে বেশি দূরে একা যেতে পারবেন না৷ যেতে হলে সঙ্গে কোনো পুরুষকে রাখতে হবে৷ তালেবান মিনিস্ট্রি ফর প্রোপাগেশন অফ ভার্চু অ্যান্ড দ্য প্রিভেনশনস অফ ভাইস এই নির্দেশনায় কোনো চালক যাতে কখনো একা দূরে যেতে আগ্রহী নারীকে গাড়িতে না তোলেন সেই হুকুমও দিয়েছে৷
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপি-কে বলেছেন, তালেবান মিনিস্ট্রি ফর প্রোপাগেশন অফ ভার্চু অ্যান্ড দ্য প্রিভেনশনস অফ ভাইস-এর নির্দেশনায় গৃহ নির্যাতনের স্বীকার হলেও নারীদের স্বামীর সংসার ছেড়ে না যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে৷
টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রে নারীদের চেহারা দেখানোও সীমিত করেছে তালেবান৷ এই নির্দেশের ফলে কোনো নারী আর টিভি শো, নাটক বা চলচ্চিত্রে অংশ নিতে পারেন না৷ বিশেষ ক্ষেত্রে অংশ নিলেও নারীকে অবশ্যই হিজাব পরতে হয়৷এক প্রতিবেদনে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানিয়েছে, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর অনেক নারীই মিডিয়া ছেড়েছেন।
২০০১ সালে নারীদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় খুলেছিল তখনকার সরকার৷ ২০২১ সালে ক্ষমতায় এসে সেই মন্ত্ণালয় বন্ধ করেছে তালেবান৷ ওপরের ছবিতে কাবুলের এক বেকারির সামনে দরিদ্র নারীদের মধ্যে রুটি বিতরণের দৃশ্য৷ রুটি দিচ্ছেন এক সাধারণ নাগরিক৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) অক্টোবরের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আফগানিস্তানে প্রাইমারির ওপরে মেয়েদের প্রায় সব স্কুলই বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান৷ এর ফলে মেয়েদের উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ কমে গেল৷
এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল। তখন তারা মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। নিষিদ্ধ করেছিল বাইরে নারীদের চাকরি করা।
গত আগস্টে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কান্দাহারের দখল নিয়েই সেখানকার বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে নারীদের বের করে দেয় তালেবান৷পরে অন্যান্য শহরেও নারীদের কর্মস্থল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে তারা৷ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, তারা মনে করেন, আফগান নারীদের পুরুষদের সঙ্গে বসে কাজ করা উচিত নয়৷
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তালেবানের শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেন, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ও পুরুষকে আলাদা বসতে হবে এবং সবাইকে ‘ইসলামি পোশাক’ পরতে হবে৷
এ ছাড়াও সম্প্রতি তালেবান বন্দুকবাজরা কাবুলে নারী অধিকার রক্ষাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানে মহিলা অধিকারকর্মীরা বিভিন্ন বিক্ষোভ মিছিল বার করে তালেবান শাসনকালে নারী স্বাধীনতা অবদমনের প্রতিবাদ করেছিলেন। ধরে নিয়ে যাওয়া মহিলাদের মধ্যে একজন, তমানা জারিয়াবি পারিয়ানি, যিনি কাবুলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি নারী বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন। বাড়িতে চড়াও হওয়া বন্দুকধারীরা তাঁকে "গ্রেপ্তার' করার সময় নিজেদের সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়। পারিয়ানির সঙ্গে তাঁর বোনকেও আটক করা হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রকাশ করা একটি সামাজিক মাধ্যমের ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে তালেবান বন্দুকধারীরা যখন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, পারিয়ানি চিৎকার করে সাহায্য প্রার্থনা করছেন। "আমাদের বাঁচান, ঘরে এখন শুধুমাত্র আমি এবং আমার বোন রয়েছি।"
একই ধরণের হামলা অন্য নারী অধিকারকর্মীদের বাড়িতেও হয়েছে বলে খবর। এ রকমই এক মহিলাকে প্রহার করে আহত পর্যন্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। নিরাপত্তার কারণে অবশ্য তাঁর নাম প্রকাশ করা হয়নি।