World
তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মকে মুছে ফেলার চক্রান্ত করছে চীন
ঢাকা, ২ ডিসেম্বর ২০২০: জিনজিয়াং প্রদেশে যেভাবে উইঘুর মুসলিমদের উপর অত্যাচার চালিয়ে তাদের ধর্মীয় এবং জাতিগত সংস্কৃতিকে নির্মূল করার চক্রান্ত করছে চীন, ঠিক সেইভাবে একই কাজ করছে তিব্বতের বৌদ্ধ জনসাধারনের সঙ্গেও।
অভিযোগ, সেখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জীবনচর্যা এবং মন থেকে ধর্মীয় চিন্তাধারাকে সরিয়ে তাদের পরিচয়ের রূপান্তর ঘটাতে চাইছে শি জিনপিংয়ের প্রশাসন। তিব্বতের বৌদ্ধদের উপর চীনের অত্যাচার একেবারেই নতুন বিষয় নয়, বহুদিনের।
১৯৫১ সালে তিব্বত দখল করার সময় থেকেই চলছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করে, তাদের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে বুদ্ধের মতবাদ ও সংস্কৃতিকে উৎখাতের প্রচেষ্টা, যা নতুনভাবে সামনে আসছে বর্তমান প্রশাসনের আমলে।
সম্প্রতি ভারতের ধর্মশালায় সেন্ট্রাল টিবেটান অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রধান লোবসাং সাঙ্গে দিল্লিতে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ পর্যন্ত তিব্বতের ৯৮ শতাংশ বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করে দিয়েছে চীন সরকার, হত্যা করা হয়েছে কয়েক লক্ষ সন্ন্যাসী এবং সন্ন্যাসীনিকে।
"চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি আমাদের ধর্মকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং এমন কি এখনও বৌদ্ধদের হত্যার পাশাপাশি সেই ধ্বংসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।"
অভিযোগ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অত্যাচারের পাশাপাশি তিব্বতের সাধারণ মানুষকে বিলাসবহুল জীবনের লোভ দেখিয়ে ধর্মের পথ থেকে অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করছে। এই উদ্দেশ্যে কম্যুনিজমের জামা পরে ধনতন্ত্রের পথে দৌড়নো আজকের ভোগবাদী চীন সরকার লাসা-সহ তিব্বতের বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করছে বলে খবর।
একই সঙ্গে চেষ্টা চলছে স্থানীয় মানুষদের ভাষা এবং জাতিগত সংস্কৃতিকে মুছে দেওয়ার। জানা গেছে, তিব্বতি ভাষার পরিবর্তে চীনের মান্ডারিন ভাষায় সেখানে এখন বৌদ্ধ ধর্মের পাঠ দেওয়া হচ্ছে।
প্রায় ৭০ বছর আগে, চীনের পিপল'স লিবারেশন আর্মি তিব্বতে সামরিক অভিযান চালানোর আগে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে তুং কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে তিব্বতিদের ধর্মীয় বিশ্বাসে কোনও রকম আঘাত না করা হয়।
তিনি বলেছিলেন তিব্বতিদের সংস্কৃতি এবং ধর্মবিশ্বাসকে যেন সম্মান দেখানো হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথে না গিয়ে অন্তত সাময়িকভাবে স্থানীয় মানুষের কাছাকাছি যাওয়া। শুধু তাই নয়, এর পরে ১৯৫১ সালে যে ১৭ দফা চুক্তি হয়, তার ৭ এবং ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তিব্বতিদের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক রীতি এবং অভ্যাস, ইত্যাদিকে সম্মান করা হবে এবং লামাদের প্রার্থনাস্থলগুলিকে সুরক্ষিত রাখা হবে।
একই সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে, চীনা সেনারা স্থানীয়দের কাছ থেকে একটি সুতোও কেড়ে নেবেনা। ইতিহাসের পরিহাস এই যে, শেষ পর্যন্ত সিসিপি তিব্বতিদের সব কিছুই কেড়ে নিয়েছে, এমন কি তাদের ভাষা এবং ধর্মপালনের অধিকারটুকুও। এই ধোঁকার রাজনীতি চীন সম্প্রতি ফিলিপিনসের সঙ্গে করেছে জলসীমা বিষয়ক বিবাদ-বিষয়ে এবং স্থলসীমানা নিয়ে, অতি সম্প্রতি, ভারতের সঙ্গে।
তিব্বতিদের উপর চীনের আক্রমণ বহুল পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল চীনের তথাকথিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়। এমন কি অর্থনৈতিক উদারীকরণের সময়েও তিব্বতের উপর চীনের লৌহমুষ্টি আলগা হয়নি এতটুকুও।
এরপর শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর প্রথাগত নজরদারির সঙ্গে শুরু হয়েছে চরম মাত্রায় অত্যাধুনিক নজরদারি। তিব্বতি বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের উপর শি জিনপিং-য়ের আক্রমণ বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।
সারা কুক নামে এক গবেষক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন: শি'র স্বৈরাচারী শাসনকালে চীনে ৩৫ কোটি জনসংখ্যার সাতটি ভিন্ন জাতির অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
'দ্য ব্যাটল ফর চায়না'জ স্পিরিট' নামে ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি লেখায় বলা হয়েছে, সর্বোতভাবে ধর্মীয় নিপীড়ন বেড়ে যাওয়া চীনে বিশেষভাবে চারটি সম্প্রদায়ের অবস্থার অত্যন্ত অবনতি হয়েছে। তারা হল, প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান, তিব্বতি বৌদ্ধ এবং হুই এবং উইঘুর দুই সম্প্রদায়ের মুসলমান।
বিটার উইন্টার নামে চীনে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার সম্পর্কিত একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে এই চারটি সম্প্রদায়ের উপর চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির আক্রমণ নিয়ে বিশদভাবে লেখা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থের প্রকাশ এবং প্রচারের উপর ধরপাকড় শি জিংপিংয়ের আমলে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। কোনও দোকানদার নিষিদ্ধ বৌদ্ধ বই বিক্রি করলে তার ৫০,০০০ রেমনামবি, অর্থাৎ প্রায় ৭১০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
কিন্তু কেন তিব্বতি বৌদ্ধদের উপর এই দমন-পীড়ন? কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির বিভিন্ন গবেষকদের মত এই যে, তিব্বতি বুদ্ধ ধর্মের ব্যাপারে চীনা জনগণের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ এবং এই ধর্মের প্রতি তিব্বতি জনসাধারণের অচল নিষ্ঠাই এর কারণ। এর ফলে তিব্বতিদের নিয়ন্ত্রকের যে ভূমিকা চীন নিয়ে চলেছে, তার বৈধতার ব্যাপারেই একধরণের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে চীন সরকার তথা সেই দেশের কম্যুনিস্ট পার্টি এবং তাই যাবতীয় দমননীতি প্রয়োগ করে বৌদ্ধ ধর্ম এবং সংস্কৃতি থেকে তিব্বতি মানুষদের বিচ্ছিন্ন করার এই প্রয়াস।
ফ্রী টিবেট এবং টিবেট ওয়াচের ২০১৭ সালের একটি যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল লারুং গার এবং ইয়ারচেন গার নামে পূর্ব তিব্বতের দু'টি বৃহত ধর্মীয় অ্যাকাডেমি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল ঠিক এই মানসিকতা থেকেই। এই দু'টি প্রতিষ্ঠানেই তিব্বতি এবং চীনা অনুগামীরা ছাড়াও দক্ষিন-পূর্ব-এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ আসতেন। এই ব্যাপারটিকেই সিসিপি-র কর্তৃত্বের পক্ষে বড় বিপদ বলে মনে করা হয়েছিল, কারণ ধরে নেওয়া হয়েছিল, এই ধরণের জায়গাগুলি তিব্বতি জাতীয়তাবাদের আখড়া।
ইসলামিকরণের নাম করে বাংলাদেশের মানুষের ভাষা-সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল পাকিস্তান। তার বন্ধুদেশ চীন চায় তিব্বতিদের ধর্ম-সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলে তাদের চীনাকরণ।