World
উইঘুর মুসলমানদের গ্রেফতারে প্রযুক্তি ভাণ্ডার ব্যবহার চীনের
ঢাকা, ১৮ ডিসেম্বর ২০২০: জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের ‘নির্বিচারে’ গ্রেফতার করতে অথবা তাদের উপর নজরদারি চালাতে ব্যাপকভাবে প্রযুক্তি এবং তথ্যভান্ডার ব্যবহার করছে চীন। পবিত্র কুরআন শরিফ পাঠ, হিজাব পরা বা হজ করতে যাওয়ার কারণে সেখানে বন্দী করা হয়েছে বহু মানুষকে। এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
এই সংস্থাটি জানিয়েছে, জিনজিয়াংয়ের আকসু অঞ্চলের দু' হাজারের বেশি বন্দীর ফাঁস হওয়া একটি তালিকা তাদের হাতে আসায় এই ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। তালিকায় বন্দীদের নামের সঙ্গেই লেখা আছে কী কারণে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
পোষাকি নাম ইন্টিগ্রেটেড জয়েন্ট অপারেশন প্ল্যাটফর্ম (আইজেওপি)। এই নামে পরিচালিত চীনের ওই অভিযানে প্রযুক্তি এবং তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে কারও পারিবারিক সম্পর্ক, যোগাযোগ, ভ্রমণ বা চীনা কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজন মনে করে এমন কারো সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে মুসলিমদের বন্দী করা হয়েছে। কাদের গ্রেফতার করা হবে, তা এই আইজেওপি প্রোগ্রাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেছে নেয়। বন্দীদের রাখা হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিবিরে। কুরআন পাঠ, ধর্মীয় পোষাক পরা অথবা বিদেশ ভ্রমণ- কে কোন ধরণের 'অপরাধ' করেছে, তার উপর নির্ভর করে ঠিক করা হয় বন্দীশিবির।
উদাহরণ হিসেবে এইচআরডব্লিউ বলেছে, মিস টি নামে জনৈক নারী বন্দী হয়েছিলেন, স্পর্শকাতর দেশের সাথে তাঁর যোগাযোগ রয়েছে বলে মনে করেছিল আইজেওপি। তালিকায় মিস টি সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ২০১৭ সালের মার্চে একটি বিদেশী ফোন নম্বর থেকে চারবার কল পেয়েছিলেন তিনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কল করে দেখেছে, সেটি মিস টির বোনের নম্বর। সংস্থাটি জানিয়েছে, মিস টির বোন বলেছেন, আকসু তালিকায় মিস টির নাম যখন যোগ করা দেখাচ্ছে, সেই সময়ের দিকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল জিনজিয়াং পুলিশ। সেই থেকে মিস টির সাথে আর সরাসরি যোগাযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তার বোন। তবে তিনি শুনেছেন, মিস টি নাকি একটি কারখানায় কাজ করছেন।
দ্বিতীয় উদাহরণে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি এক ব্যক্তিকে কুরআন শরিফ পাঠ করার কারণে বন্দী করা হয়েছিল। ২০০০ সালের শুরুর দিকে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয় তাঁর স্ত্রীকে পর্দা করার অনুমতি দেওয়ার জন্য।
মানবাধিকার সংস্থাটির তথ্যমতে, আকসু তালিকায় প্রায় ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ২০০ জনেরও বেশি বন্দীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা উগ্রবাদের অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে তাদের অপরাধের বিষয়ে কোনো যুক্তিসঙ্গত তথ্যপ্রমাণ দেখায়নি চীনা কর্তৃপক্ষ। এইচআরডব্লিউর চীনবিষয়ক সিনিয়র গবেষক মায়া ওয়াং বলেন, জিনজিয়াংয়ে তুর্কি মুসলিমদের ওপর চীনের নৃশংস নিপীড়ন প্রযুক্তির মাধ্যমে কিভাবে গতিশীল করা হচ্ছে, আকসু তালিকা দেখে তা আরো সূক্ষ্মভাবে বোঝা যায়।
তিনি বলেন, তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের পরিবারের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে চীনকে: কেন তাদের আটক করা হয়েছিল এবং তারা এখন কোথায়?
জাতিসঙ্ঘের ধারণা, জিনজিয়াংয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় বন্দিশিবিরগুলোতে ১০ লাখেরও বেশি তুর্কি মুসলিম আটক রয়েছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই উইঘুর সম্প্রদায়ের। সমাজকর্মীদের মতে, তুর্কি মুসলিমদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে এবং চীনা সরকারের ওপর বিশ্বস্ত রাখার লক্ষ্যেই পরিকল্পিতভাবে এ বন্দিদশা সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও চীন বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, বন্দিশিবির নয়, ধর্মীয় উগ্রবাদ দমনের উদ্দেশ্যে সঙ্কটাপন্ন প্রদেশগুলোতে কিছু কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলা হয়েছে মাত্র।
সংখ্যালঘু উইঘুরদের উপর চীন সরকারের নানা ধরণের নির্যাতনের প্রতিবাদে সরব বিশ্বের বিভিন্ন মহল। এরই মধ্যে এই প্রতিবাদে অংশ নিয়ে এক অসাধারণ নজির গড়লেন বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্সের তারকা ফরোয়ার্ড আতোয়ান গ্রিজম্যান। চীনের তথ্যপ্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে এই দমননীতির সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন গ্রিজমান। আর তাই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পৃক্ততার ইতি টেনেছেন তিনি। সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, হুয়াওয়ের সঙ্গে স্পনসরশিপ চুক্তি বাতিল করেছেন গ্রিজমান।
সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে হুয়াওয়েকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেখানে জানানো হয়, উইঘুরদের চিহ্নিত করতে একটি সফটওয়্যার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে হুয়াওয়ে। এই সফটওয়্যার মুখ পরীক্ষা করে উইঘুরদের চিহ্নিত করতে পারবে, যা সাহায্য করবে চীনের পুলিশ বিভাগকে। চীনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উইঘুরদের চিহ্নিত করে দমননীতির আশ্রয় নিচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে হুয়াওয়ের এই সফটওয়্যার পরীক্ষার খবর প্রকাশ হওয়ার পর কাল প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে স্পনসরশিপ চুক্তি বাতিল করেন ২৯ বছর বয়সী এই তারকা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে গ্রিজমান লিখেছেন, ‘উইঘুর অ্যালার্ট নামে মুখ দেখে চেনা যায় এমন সফটওয়্যারের উন্নতিতে সাহায্য করছে, এমন সন্দেহ থাকায় আমি তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানছি।’
গ্রিজমান আরও লিখেছেন, ‘আমি চাই উইঘুর এই অভিযোগ খণ্ডন করুক। এই গণ দমননীতির বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিক এবং নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে মানবতা ও নারী অধিকারের উন্নতিতে সাহায্য করুক।’
এ বছরের জুলাইয়ে স্যামসাং ও অ্যাপলকে টপকে বিশ্বের সেরা স্মার্টফোন ব্র্যান্ড হিসেবে উঠে এসেছে হুয়াওয়ে। ২০১৭ সাল থেকে গ্রিজমান ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক দূত এবং তাদের বিজ্ঞাপনেও অংশ নিয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমগুলোর তদন্তে উঠে এসেছে, উইঘুরদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করতে কড়া দমননীতির আশ্রয় নিয়েছে চীন। হত্যার মতো ঘৃণ্য কাজ চালিয়ে যাওয়ায় চীনের নিন্দা চলেছে বিশ্বজুড়ে। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইপিভিএম জানায়, উইঘুরদের মুখ দেখে চিনতে একটি সফটওয়্যার তৈরির কাজে জড়িত রয়েছে হুয়াওয়ে। চীনের সরকার উইঘুরদের চিহ্নিত করতে এটি ব্যবহার করতে পারে। অবশ্য হুয়াওয়ের এক মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, অভিযোগটি সম্পূর্ণ ‘অগ্রহণযোগ্য’ এবং প্রতিষ্ঠানের নীতি-নৈতিকতার মধ্যে কোনো জাতির প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব নেই।