Column

শিল্পদ্রব্যের গুনমাণ: কোথায় চীনের বিশ্বাসযোগ্যতা
Wallpaper

শিল্পদ্রব্যের গুনমাণ: কোথায় চীনের বিশ্বাসযোগ্যতা

Bangladesh Live News | @banglalivenews | 15 Sep 2020, 02:29 am

সীমান্তে অনভিপ্রেত সংঘর্ষের ফলে পারস্পরিক সম্পর্কে উত্তেজনা ছড়ানোয় চীনা পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। বন্যার জলের মত ঢুকে পড়ে ভারতের বাজার দখল করতে চাওয়া কম দামী চীনা শিল্প-পণ্যের গুনগত মান নিয়ে অভিযোগ, অসন্তোষ অনেকদিনেরই। বাজার-অর্থনীতিতে পণ্যের গ্রহণযোগ্যতার একটি অন্যতম কারণ তার কম দাম, বিশেষ করে পণ্য যদি দেখে মনে হয় উন্নত মানের- আসলে উন্নত না হলেও।

ঠিক এই ব্যাপারটিই ভারতে ঘটে চলেছিল বছরের পর বছর ধরে। কম দামের, কিন্তু নিকৃষ্ট মানের চীনা সামগ্রী ভারতের বাজার জুড়ে বসায় প্রতারিত হচ্ছিলেন ক্রেতারা। শস্তার পণ্য যদি খেলনাপাতি ইত্যাদের মত অতি সাধারণ জিনিষ হয়, তা-ও হয়তো উপেক্ষা করা চলে, কিন্তু যদি তা কম দামের লোভ-দেখানো নিম্ন মানের ‘হাই-ভ্যালু প্রোডাক্ট’ হয়, তখন তা বিপজ্জনক বৈ কি। তাই ভারত সরকারের এই সাহসী পদক্ষেপ মানুষের ক্ষোভকে বৈধতা দিল।

তার থেকেও বড় কথা, সুরক্ষার আশ্বাস দিল দেশীয় নির্মাতাদের। শুধু ভারত নয়, প্রায় সব ধরনের শিল্প-সামগ্রী, বিশেষত ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জামের ক্ষেত্রে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বাজার চীনা পণ্যের দখলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনের তৈরি যুদ্ধাস্ত্র এবং সামগ্রী দিয়ে এশিয়া এবং আফ্রিকার বাজার দখলের খেলা।

ভারতের কড়া মনোভাবের সম্মুখীন হয়ে চীন এখন নিশানা করেছে বাংলাদেশকে। ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যকে চীনের বাজারে শুল্কবিহীন প্রবেশের অধিকার দেওয়ার পিছনে সেই অঙ্কই কাজ করছে। এছাড়া একটা বড় রাজনৈতিক কারণও আছে- তা হল, ভারতের পরম মিত্র বাংলাদেশকে যথাসম্ভব নিজের দিকে টানা- যে বাংলাদেশকে চীন স্বীকৃতি দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে পাক-পন্থী, কুচক্রী শক্তি দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর।

তবে বাংলাদেশের জন্য আপাত দৃষ্টির এই ঢালাও ব্যবস্থা চীন ততদিনই রাখবে, যতদিন পর্যন্ত এর থেকে সে রাজনৈতিক সুবিধা পাবে। আগে বাংলাদেশ জাপান, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যের উপরে নির্ভরশীল ছিল। গত এক দশক বাংলাদেশের বাজার বহুলাংশে চীনের দখলে। এর কারণ একই- দেখতে একই রকম পণ্য অনেক কম দামে বিক্রি করে চীন। তবে দেখতে যতই চটকদার হোক, চীনা পণ্য মানেই নিম্নমানের- এ অভিজ্ঞতা এখন অনেকেরই। এ ব্যাপারে টুনি বাল্ব যেমন, বৈদ্যুতিন সরঞ্জামও তেমন। যেমন সিগারেট লাইটার, তেমনই যুদ্ধাস্ত্র।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমরসম্ভাব বিক্রির ব্যাপারে চীন এখন পাঁচ নম্বরে-আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং জার্মানির পরেই। অল্প সময়ের মধ্যেই এই উত্থান। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে, তাদের উৎপাদিত জিনিষের গুনমান মোটেই উঁচু নয়, বরং নিচু।

এ-ব্যাপারেই তীব্রভাবে বলেছেন আর ক্লার্ক কুপার, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট অফ পলিটিকাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সঃ “দাম কমানোর নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং কখনও সরাসরি উৎকোচ দিয়ে চীন খোলা দরজার সুযোগ নিয়ে একেবারে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে তার প্রভাব খাটাতে এবং খবর সংগ্রহ করতে।”

চীনের যুদ্ধসরঞ্জাম ব্যবহারের নিদারুণ অভিজ্ঞতা সম্প্রতি হয়েছে জর্ডনের, যারা চীনের এয়ারোস্পেস সায়েন্স অ্যানড টেকনোলজি কর্পোরেশনের কাছ থেকে ছ’টি সিএইচ-৪বি আনম্যান্‌ড কমব্যাট অ্যারিয়েল ভেহিকল (ইউসিএভি) কিনে। তিন বছরের মধ্যেই সেগুলিকে বাতিল করে বেচে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছে জর্ডনকে।

২০১৪ সালে থেকে এ পর্যন্ত চীন অন্য দেশের কাছে মোট ৩০টি ইউসিএভি বিক্রি করেছে, প্রত্যেকটির দাম ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আমেরিকায় তৈরি একই ধরণের ড্রোনের যা দাম, তার ভগ্নাংশ মাত্র।

তাঁর একটি বক্তৃতায় কুপার চীনা সমর-সামগ্রীর গুনমান নিয়ে বলতে গিয়ে আরও একটি ভয়াবহ উদাহরণ দিয়েছেন। ক্যামেরুন ২০১৫ সালে চীনের কাছ থেকে ৪টি হারবিন জেড-৯ অ্যাটাক হেলিকপ্টার কিনেছিল। সেগুলি তারা হাতে পাওয়ার পরেই একটি ভেঙে পড়ে। কেনিয়া কিনেছিল নরিনকো ভি এন ফোর আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার। টেস্ট ফায়ারিঙের সময় বেচতে আসা চীনের প্রতিনিধিরাই নাকি সেগুলির ভিতরে বসতে চাননি। তা সত্ত্বেও বেচা-কেনা সম্পন্ন হয়ে যায়, তারপর- অতীব দুঃখের- শোনা গেছে, ওই আর্মার্ড ভেহিকলের ভিতরে নিহত হয়েছেন ডজনখানেক কেনিয়ার সৈন্য।

২০০১ সালের আগে পর্যন্ত চীনের জিনিষ তেমন ভাবে বাংলাদেশে জায়গা পায়নি। পরিস্থিতি পালটায় ওই বছরের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোটের জয়লাভের পর। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তারা দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সরঞ্জামের জন্য চীনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারকেও এসব চুক্তির জের টানতে হয়।

মায়ানমার চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র কেনার পর বাংলাদেশ আপত্তি জানালে চীন বাংলাদেশের কাছেও সাবমেরিন বিক্রির প্রস্তাব দেয় এবং একরকম বাধ্য হয়েই তা মেনে নেয় বাংলাদেশ। লোভনীয় শর্তের টোপ দিয়ে চীন বাংলাদেশের কাছে ব্যবহৃত এবং নতুন, দু-রকম যুদ্ধ সরঞ্জামই বিক্রি করছে। নতুন-পুরনো নির্বিশেষে কোনও কোনও অস্ত্র চালু করার আগেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে বলে শোনা গেছে।

এপ্রিল মাসে নিজের দেশেই চীনা নৌবাহিনীর সর্বাধুনিক যুদ্ধজাহাজে কোনও কারণ ছাড়া ভয়াবহ আগুন লেগে যাওয়ার পর থেকে জাহাজের উপাদান এবং তার কারিগরির গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন বড় আকারে দেখা দিয়েছে। অথচ জাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে চীন বিশ্ববাজারে রীতিমত আধিপত্য বিস্তার করেছে।

পাকিস্তান নৌবাহিনী ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের দেশের পরম ‘মিত্র’ চীনের তৈরি এফ ২২ পি ফ্রিগেটগুলির পুননির্মাণের জন্য অনুরোধ কর। এই জাহাজগুলি ছিল প্রযুক্তিগত ত্রুটিযুক্ত। কিন্তু তাতে কোনও কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তুরস্কের শরণাপন্ন হতে হয় পাকিস্তানকে।

উদার ঋণ ব্যবস্থা এবং তুলনামূলক কম দামের কারণে গত এক দশকে চীন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান অস্ত্রদাতায় পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আমদানি করা মোট অস্ত্রের ৮২ শতাংশ ছিল চীন থেকে সংগ্রহ করা। কিন্তু জানা গেছে, ২০০৩ সালের এপ্রিলে চীনের তৈরি পিএলএ নেভি মিং ক্লাস সাবমেরিন ৩৬১ সমুদ্রের মধ্যে যান্ত্রিক গোলযোগে পড়ে। এছাড়া চীনের থেকে সংগ্রহ করা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২০টিরও বেশি যুদ্ধ জাহাজের কয়েকটিতেও ত্রুটি ধরা পড়েছে।

শেনজিয়া শিপইয়ার্ড থেকে সম্প্রতি ডেলিভারি নেওয়া দুটি চীনা যুদ্ধ জাহাজ একাধিক ত্রুটি নিয়ে ২০২০ সালে মংলা বন্দর পৌঁছায়। সমুদ্রে পরীক্ষার সময়, জাহাজ দুটির নেভিগেশন রাডারে ত্রুটি ধরা পড়ে।

কোভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে অনেক ক্রেতা দেশ চীন সফর বাতিল এবং তাদের দেশে চীনা নাগরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। কোভিড-১৯-এর কারণে থাইল্যান্ড চীন থেকে ২২ বিলিয়ন ডলারের ইউয়ান ক্লাসের (টাইপ ০৪১) দুটি সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা বাতিল করেছে। সাম্প্রতিক একটি সিএসআইসি প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে চীনের নতুন আন্তর্জাতিক শিপিং চুক্তি বাতিলেরও সম্ভাবনা রয়েছে।

মহামারী কারণ হতেই পারে, কিন্তু তাতে চীনে তৈরি ‘শস্তা’ জিনিষ নিয়ে দিনে দিনে বাড়তে থাকা প্রশ্ন চাপা থাকেনা, সুরক্ষিত থাকেনা চীনের সততা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা।