Column

Attempts made to mislead investigation and save perpetrators failed

Attempts made to mislead investigation and save perpetrators failed

Bangladesh Live News | @indiablooms | 01 Nov 2018, 06:42 am
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে অবশেষে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সভায় বীভৎস গ্রেনেড আক্রমণের রায় ঘোষিত হল। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল ১৯ জনকে এবং সমসংখ্যক ব্যক্তি পেল যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই গ্রেনেড আক্রমণ একটি অন্যতম ভয়ানক হত্যালীলার ঘটনা।এই ঘৃণ্য আক্রমণের ঘটনা যারা ঘটিয়েছিল, তাদের রক্ষা করার জন্য বিএনপি-র চেয়ারপার্সন এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কোনও রকমের চেষ্টার বাকি রাখেন নি। লোক দেখানো বিভিন্ন রকমের তদন্ত করিয়ে তখনকার বিএনপি-জামাত সরকার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল যে, বিএনপি সরকারকে হেয় করে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসাবে দেখানোর উদ্দেশ্যে আওয়ামি লিগ নিজেই এই আক্রমণের ঘটিয়েছে (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি)। "বহির্দেশীয় শত্রু"র প্ররোচনায় ভারতে পালিয়ে থাকা কিছু দাগী অপরাধী এই আক্রমণ চালিয়েছিল- এমন প্রমাণ করারও চেষ্টা হয়।

 

সেই সময়কার বি এন পি সরকার ঘটনার তদন্ত প্রবাহ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যা করা সম্ভব, সবই  করেছিল।  আটক করা হয়েছিল সব মিলিয়ে ২০ জনকে, যাদের মধ্যে জয় মিয়া নামে এক মাদকাসক্ত ব্যক্তি সহ তিনজনকে নানা পারিতোষিক দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে  স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়ানো
হল এই বলে যে তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা যায়নি। পরে জয় মিয়া জানিয়েছিল যে এই স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য  আইনরক্ষক এবং গোয়েন্দা অফিসারেরা  তাকে সিলিং ফ্যানের সংগে ঝুলিয়ে মারধোর করেছিল।

 

এর আগে একাধিক তদন্ত করিয়ে তখনকার বিএনপি-নেতৃত্বাধীন জোট সরকার প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, সরকারের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্যে আওয়ামি লিগ নিজেই এই আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। এই কথা তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াই বলেছিলেন। এও প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল যে, 'বিদেশি শত্রু'র প্ররোচনায় এই ঘটনা ঘটেছে এবং ভারতে লুকিয়ে থাকা কিছু দাগী অপরাধীকে দিয়ে এই আক্রমণ করানো হয়েছে।

 

এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলে বিএনপি সরকার এফ বি আই এবং ইন্টারপোলের সাহায্য চায়, কিন্তু কী ছিল সেই সব তদন্তের ফল, সে কথা কোনওদিন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।   ঘটনাটি যে তৎকালীন বি এন পি - নেতৃত্বাধীন সরকারের ভাবমূর্তিকে হেয় করতে আওয়ামী লীগেরই কারসাজি, তা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছিল।

 

এই গ্রেনেড আক্রমণের ঘটনায় নতুন মোচড় পড়ে  যখন বিচারক মহম্মদ জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সরকারের কাছে জমা দেওয়া কমিশনের রিপোর্টের সংক্ষিপ্তসারে দাবি করা হয় যে, ঘটনার পিছনে প্রধান মস্তিষ্ক যারা, তাদের চিহ্নিত করা গেছে। এই রিপোর্টে ভারতের নাম না করে বলা হয়েছে যে, একটি বৃহৎ বিদেশি শক্তি, যারা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পিছনে সক্রিয়ভাবে ছিল, তাদের গোয়েন্দা বিভাগই এই আক্রমণের মূল হোতা। রিপোর্টটির উপসংহারে বলা হয়েছে,  যে 'শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা বিভাগ' ধর্মনিরপেক্ষতা ও তার বিরোধী শক্তি এবং স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে থাকা বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল, প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণে গ্রেনেড আক্রমণ গঠনায় তাদের জড়িত থাকার ইঙ্গিত স্পষ্ট।

 

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছিল, যে বিদেশি শক্তি বাংলাদেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ হিসেবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে দিতে চায়না, তারা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এর মধ্যে যেমন ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে যশোরের 'উদীচী বিস্ফোরন'-এর ঘটনা আছে, তেমনই আছে ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্টের ঘটনাও এবং এর উদ্দেশ্য দেশে অস্থিরতা তৈরি করা।সেই বিদেশি সংস্থার নাম না করে এও অভিযোগ করা হয় যে, তারা আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের সহযোগিতায় বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র- এই প্রচার চালাচ্ছে।

 

রিপোর্টের শেষ অংশে কমিশন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে শত্রুকে চিহ্নিত করতে জনগণকে আহ্বান জানায়। কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকায় এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি।তখনকার গৃহ প্রতিমন্ত্রী লূতফোজ্জামান বাবর, যিনি তদন্তকে বিপথে চালিত করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন, এই আক্রমণে জড়িত ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীর সম্পর্কে খবরাখবর দেওয়ার জন্য এক কোটি  টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেন। তারপরেই বি এন পি -নেতৃত্বাধীন সরকার মামলাটিকে ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেয়।

 

এর পরে ঘটনাক্রমের বিস্ময়কর পরিবর্তনে ১৯৯৬ সালে ঢাকায় একটি বোমা বিস্ফোরনের পুরনো মামলায় হরকত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামি(হুজি)-র কমান্ডার মুফতি আবদুল হান্নান সহ ঐ দলের কিছু কর্মীকে ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্টে আওয়ামি লিগের জনসভায় গ্রেনেড আক্রমণের ঘটনার ব্যাপারে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘ জেরার মুখে হুজি কমান্ডার গ্রেনেড আক্রমণের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করে।  পরিকল্পনা এবং বোমা বিস্ফোরণে জড়িত থাকা আরও ২৭ জনের নাম প্রকাশ করে সে।

 

হান্নান যাদের নাম করেছিল, তাদের মধ্যে আবদুস সালাম পিন্টু সহ বেশ কিছু প্রাক্তন মন্ত্রী এবং বিএনপি নেতার নাম ছিল। তার কথায় প্রকাশ, আওয়ামি লিগ জনসভার উপর গ্রেনেড হানার পরে সে নিজে এবং অন্যা আততায়ীরা বিএনপির শীর্ষ নেতা এবং প্রাক্তন মন্ত্রী যেমন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার এবং আলতাফ হোসেন চৌধুরি এবং এ ছাড়াও জামাতের প্রধান তথা প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামির মত ব্যক্তিদের কাছ থেকে নিরাপত্তা পেয়েছিল। হান্নান এ-ও বলে যে,বিএনপির চেয়ারপার্সন এবং পাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তাঁর পুত্র তথা বিএনপির সিনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট তারিক রহমান এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুতফোজ্জামান বাবর তাকে এই আক্রমণ চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

 

যখন সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের শাসন ক্ষমতায় ছিল, সেই সময় সি আই ডি ঢাকায় একটি বোমা বিস্ফোরণের ব্যাপারে কয়েকজন হুজি সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে ছিল হুজির এক কম্যান্ডার, আবদুল হান্নান। জিজ্ঞাসাবাদের সময় হুজি কম্যান্ডার হান্নান আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড আক্রমণে তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। এই আক্রমণের পরিকল্পনা এবং তার প্রয়োগে জড়িত হিসেবে সে বি এন পি -র বিশিষ্ট নেতা ও মন্ত্রী সহ আরও ২৭ জনের নাম করে। এই ব্যক্তি আরও প্রকাশ করে যে, আক্রমণের পরে সে নিজে এবং অন্যান্য আততায়ীরা জনা দুয়েক বি এন পি নেতা এবং মন্ত্রীর নিরাপদ আশ্রয়ে ছিল। সে এমন কি এ কথাও জানায় যে, বি এন পি -র চেয়ারপার্সন এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তাঁর পুত্র তারিক রহমান এবং গৃহ প্রতিমন্ত্রী লুতফরজ্জামান বাবর শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য তাদের এই আক্রমণ চালাতে বলেছিলেন।

 

এর পর ঢাকার একটি আদালত ২০০৮  বি এন পি এবং হুজির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে। কিন্তু মামলাটি চলতে থাকে শম্বুক গতিতে। জানুয়ারি, ২০০৯ তে শেখ হাসিনা-নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঢাকার স্পিডি ট্রায়াল ট্রাইব্যুনাল গ্রেনেড আক্রমণের ব্যাপারে পুনরায় তদনের আদেশ দেয়। এর আগে সি আই ডি -র তিন জন উচ্চপদস্থ অফিসার বি এন পি সরকারের নির্দেশমত মামলাটিকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করেছিলেন।

 

এই পুনর্তদন্তে প্রকাশ পায় যে ঘটনায় জড়িত ছিলেন তৎকালীন সরকারের প্রায় সমস্ত প্রথম সারির মন্ত্রী এবং নেতারা। এর ফলে চার্জ আনা হয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারিক রহমান, খালেদার ভ্রাতুষ্পুত্র সইফুল আলম ডিউক, তাঁর প্রাক্তন পলিটিকাল সেক্রেট্রারি হ্যারিস চৌধুরী এবং তাদের ঘনিষ্ঠ উচ্চপদস্থ  আমলা এবং পুলিস অফিসারদের বিরুদ্ধে।

 

যে গোপন বৈঠকে শেখ হাসিনার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য হুজি জঙ্গিদের নির্দেশ দেওয়া হয়, সেখানে তারিক রহমানের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুতফোজ্জামাণ বর, হ্যারিস চৌধুরি, জামাতের সেক্রেটারি জেনা্রেল এবং তৎকালীন সমাজ কল্যান মন্ত্রী আলি আহসান মহম্মদ মোজাহিদ (যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি হয়েছে) এবং এন এস আই-এর ডিরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরি। বৈঠকটি হয়েছিল হাওয়া ভবনে।

 

এই আক্রমণ যে সময় হয়,সেইসময় দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তি মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমি সাক্ষী হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বলেন যে, এই আক্রমণ এবং তার তদন্তের ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তা তাঁকে ধমক দিয়ে  তদন্তের ব্যাপারে অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছিলেন।

 

"কোথা থেকে আপনি এই সব হাস্যকর খবর এনেছেন ? তাজুদ্দিন (আক্রমণের পিছনে অন্যতম মস্তিষ্ক) যদি পাকিস্তান বা অন্য কোথাও যায়, তাতে আপনার মাথা ব্যথার কী আছে ?," জেনারেল রুমির জবানবন্দি অনুযায়ি খালেদা জিয়া বলেছিলেন সেই সময়। শেখ হাসিনার উপর আক্রমণের পিছনে থাকা অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রী মৌলানা তাজুদ্দিন এবং বিএনপি নেতা তথা প্রাক্তন ডেপুটি মিনিস্টার আবদুস সালাম পিন্টুর ভাইকে  নিরাপদে পাকিস্তানে যেতে দেওয়ার অনুমতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই দিয়েছেন, এই খবরের যাথার্থ জেনারেল রুমি জানতে চাওয়াতেই এই প্রতিক্রিয়া ছিল খালেদা জিয়ার।

 

ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জেনারেল রুমির এই  বিবৃতি  বাংলা সাপ্তাহিক 'সাপ্তাহিক ২০০০'- এ ছাপা হয়েছিল। সেই সময় এই আক্রমণের বিচার চলছিল, যাতে মূল চক্রী হিসেবে  অভিযুক্ত ছিলেন তারিক রহমান সহ বেশ কয়েকজন অতি উচ্চস্থানীয় কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি।

 

তদন্তকে বিপথে চালিত করার সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ঝুলি থেকে বেড়ালও বেরিয়ে পড়েছে। আদালত লুতফোজ্জামাণ বাবর এবং আরও ১৮ জনকে গ্রেনেড আক্রমণ মামলায় প্রাণদণ্ড দিয়েছে। ওই ১৮ জনের পাশাপাশি বি এন পি-র অয়াক্টিং চেয়ারপার্সন তারিক রহমানকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।