Column

Dynamics of Bangladesh-China Relations
এই সফরকালে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ সম্বর্ধনা দিয়ে লাল কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া হয় তাঁর জন্য। এই সফরের তাৎক্ষনিক ফলশ্রুতি হিসেবে ন'টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মধ্যে আছে রোহিংগিয়াদের আশ্রয়দানের জন্য অনুদান, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, লগ্নি, বিদ্যুৎ সংস্কৃতি এবং পর্যটন ক্ষেত্রে সহযোগিতা।
যদিও প্রাথমিকভাবে চিনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিন-পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অন্তরায় ছিল, এই দুই দেশ তারপর থেকে অনেকদূর এগিয়ে গিয়ে পারস্পরিকি স্বার্থভিত্তিক একটি স্বাধীন সম্পর্ক স্থাপন করেছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের জন্মলাভের সময় চিন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল এবং রাষ্ট্রসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ পাওয়ার বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করেছিল। চিনের সেই সময়কার পাকিস্তানপন্থী অবস্থান বাংলাদেশের জনগণের ভাবাবেগকে আঘাত করেছিল।
জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে তোলায় চীনও সহজ অর্থনৈতিক সাহায্য এবং বিনামূল্যে সামরিক সাহায্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি শক্ত জমি তৈরি করেছিল। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয় দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশ এখন বেজিং-এর রাজনৈতিক-সামরিক হিসেব নিকেশের একটি গুরুত্বপূর্ন চরিত্র।
২০১৬ সালে চিনা প্রেসিডেন্টের সেই সফরের সময় থেকে পাঁচটি বৃহৎ প্রকল্পের জন্য ৪.২৯ বিলিয়ন ডলার চৈনিক ঋণ বাংলাদেশে এসেছে। পদ্মা রেল যোগাযোগ থেকে কর্নফুলিতে নদী-সুড়ংগ এবং অয়েল পাইপ লাইনের মত প্রকল্পগুলি ছিল এগুলির মধ্যে। আরও ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের চৈনিক ঋণ আসার কথা আছে চলতি বছরে।
চিনের ঋণ নিয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে চাওয়া এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে ঢাকাকে কিন্তু সতর্ক হয়ে চলতে হবে। চিনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' প্রকল্পে যারাই অংশ নিয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ততদিনই ভালো কেটেছে যতদিন অর্থ এসেছে। যখনই ঋণ পরিশোধের সময় এসেছে, গোলমাল বেঁধেছে তখনই। শ্রীলংকা এবং পাকিস্তানের মত বহু দেশেরই রাজকোষ ফুরিয়ে গেছে এই ঋণ শোধ করতে গিয়ে।
পরিকাঠামো ক্ষেত্রে চিনের দেওয়া বিপুল ঋণ আদতে চিনের বহু কোটি ডলারের 'রোড অ্যান্ড বেল্ট' উদ্যোগের অঙ্গ। এই উদ্যোগের লক্ষ্য চিনকে কেন্দ্র করে এশিয়া থেকে ইউরোপের বহু দেশকে বাণিজ্যের দিক থেকে সংযুক্ত করা। এই ক্ষেত্রে রাস্তার অর্থ চিনের সংগে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া, ওশিয়ানিয়া এবং উত্তর আফ্রিকাকে সংযুক্ত করে ৬,০০০ কিমি সমুদ্রপথ খুলে দেওয়া। অন্যদিকে বেল্ট উদ্যোগের অর্থ চিনকে মধ্য এবং পশ্চিম এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের সংগে রেল এবং সড়কপথে সংযুক্ত করা।
শ্রীলংকায় চৈনিক লগ্নী শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাইথরিপালা সিরিসেনার শিরঃপীড়া এবং শ্রীলংকা-চিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রীলংকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের আমলে বৃহৎ পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির জন্য চিন বিপুল ঋণ দিয়েছিল।
এই বিপুল ঋণ পরিশোধ করা শ্রীলংকার পক্ষে সম্ভব হবেনা বলে আশংকা করছেন সমালোচকেরা। চায়না কম্যুনিকেশনস নির্মিত কলম্বো পোর্ট সিটি এরকমই একটি বিতর্কিত প্রুকল্প, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির সঙ্গে যার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে চিন। কলম্বো পোর্ট কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ( সি সি সি ) চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির একটি সাবসিডিয়ারি সংস্থা। শ্রীলংকা পোর্ট অথরিটির সহায়তায় নির্মাণ কাজ করার জন্য ১.৪ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের বরাত দেওয়া হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত এই সংস্থাকে। এদের কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণ দূর্নীতি। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এদের কাজ শুরু হয়।
ঋণ শোধ করতে শ্রীলংকাকে এখন সরকারের আয় করা সমস্ত রাজস্বের ৯০ শতাংশ খরচ করতে হচ্ছে। এই সমস্ত প্রকল্পগুলি কী ভাবে লাভ করবে এবং তা দিয়ে ঋণ শোধ করা যাবে কি না, তা সরকারের জানা নেই। এখন সরকার, বিশেষত কলম্বো পোর্ট সিটির ব্যাপার্ চিনের থেকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে। বলা হচ্ছে, সি সি সি সি এই প্রকল্পে দৈনিক ৩৮০,০০০ ডলার ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে। পরিবেশগত ছাড়পত্রের অভাবে কলম্বো পোর্ট সিটি প্রকল্পটি বাতিল করে দেওয়ার জন্যেও চাপ আসছে। কিন্তু চিন তাতে রাজি নয়, কারণ এই প্রকল্পটি ভারত মহাসাগরে ভৌগলিক স্ট্র্যাটেজিগত দিক দিয়ে পা রাখার জায়গা করে দেবে।
শ্রীলংকা থেকে আসা খবরের ইঙ্গিত, চিন ওই ইনভেস্টমেন্ট জোনটি বিভিন্ন ধরণের সামগ্রী তৈরির কাজে ব্যবহার করবে এবং শ্রীলংকা ভারতের থেকে যে মুক্ত বাণিজ্যের সুবিধা পায়, তার সুবিধা নিয়ে সেগুলি ভারতে রপ্তানি করবে তারা। সর্বোপরি, শ্রীলংকার মানুষ চিন্তিত এই ভেবে যে, সময়ের সংগে ওই জায়গাটি চিনা কলোনিতে পরিণত হবে। অন্য একটি ঘটনায়, নরচ্ছোলাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় শ্রীলংকা সরকার সেটির মালিকানা এখন ডেট-ইকুইটি সোয়াপের ভিত্তিতে চিনাদের হাতে তুলে দিচ্ছে।
হাম্বানটোটা পোর্ট যেমন সমুদ্রপথে চিনের সিল্ক রুটের পক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ন কেন্দ্র, সেরকম পাকিস্তানের গদর পোর্টও ইরান এবং উপসাগরীয় দেশগুলি থেকে তেল এবং গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সমুদ্রপথগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার লক্ষ্যে চিন ও পাকিস্তানের একটি যৌথ কর্মকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই গদর পোর্ট চিনকে ২০৫৯ পর্যন্ত লিজে দেওয়া আছে। এই বন্দর প্রকল্পটির জন্য চিন ৩.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল। চিন-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোরের মধ্যে যে সব প্রকল্প আছে, সেগুলি সব মিলিয়ে ৫১ বিলিয়ন ডলারের। চিনের অর্থানুকুল্যে গড়া এই ইকনমিক করিডোর থেকে কে লাভবান হবে, সে বিষয়ে পাকিস্তানের মধ্যেও সন্দেহ আছে।
২০১৫ সালের নির্বাচনের পরে শ্রীলংকা এখন অ-লাভজনক এবং জাতীয় রাজনীতির অংশ হয়ে যাওয়া চিনা প্রকল্পগুলিক ফিরে দেখছে। রাস্তা, বন্দর এবং রেলযোগাযোগকে পুনরুজীবিত করতে চিনের থেকে বিপুল ঋণ নেয়ার পরে পাকিস্তানও এখন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। পাকিস্তানের নেওয়া এই ঋণ চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অঙ্গ ৬২ বিলিয়ন ডলারের চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর পরিকল্পনার একটি অংশ।
চিনের এই পরিকল্পনা পাকিস্তানের ঘাটতিকে অস্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে এসেছে। সি পি ই সি -সম্পর্কিত আমদানির ফলে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দু'বার মুদ্রা মান হ্রাস করতে হয়েছে এবং তা করার পরেও সঞ্চিত ভাণ্ডারের এক তৃতীয়াংশ বেরিয়ে গেছে। পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ এখন ৯১. ৮ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে- যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি। ধার শোধ করতে না পেরে পাকিস্তান এখন চিন থেকে পাওয়া তার আগের ঋণের দুই-তৃতীয়াংশের পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে সাত শতাংশের মত উঁচু হারে সুদের বিনিময়ে।
বর্তমানে দু' মাসের বকেয়া আমদানি বিল মেটানোর চাপে পড়ে পাকিস্তান এর থেকে রেহাই পাবার জন্য আই এম এফ-এর দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু আমেরিকা, আই এম এফ-এর সব থেকে বড় অংশদাতা আমেরিকা এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়, কারণ তারা চায়না আই এম এফ-এর অর্থ ঋণ পরিশোধের জন্য চিনে যাক।
অতি সম্প্রতি মালয়েশিয়া চিনের অর্থে হতে চলা দু'টি সীমান্ত এবং সড়ক প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে। এ দু'টির একটি সাউথ চায়না সী অবধি একটি রেল লিংক এবং একটি গ্যাস পাইপ লাইন। মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আশংকা করছেন প্রকল্প দু'টি তাঁর ঋণ -ভারগ্রস্ত দেশের পক্ষে অতীব খরচসাপেক্ষ।
আফ্রিকার জিবৌটি তাদের একটি গুরুত্বপূর্ন বন্দরের নিয়ন্ত্রণ একটি বেজিং-কেন্দ্রিক কোম্পানির হাটে তুলে দিতে চলেছে। জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ ইংগিত করছে যে আফ্রিকায় চিনের দেওয়া ঋণের পরিমাণ গত পাঁচ বছরের উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আফ্রিকায় চৈনিক ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে আছে অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, সুদান, কেনিয়া এবং কঙ্গো।
আন্তর্জাতিক স্তরের থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের সাম্প্রতিক তথ্য জানাচ্ছে, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আট অংশগ্রহণকারী- জিবৌটী, কিরঘিজস্তান, লাওস, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনেগ্রো, পাকিস্তান এবং তাজিকিস্তান- সবাই পরিকাঠামো প্রকল্প রুপায়ন করতে গিয়ে চিনের ঋণের কবলে পড়েছে।
ঢাকার এ কথা মনে রাখা দরকার যে এই সব দেশগুলিতে ঋণ - জি ডি পি রেশিও ক্রমেই ঊর্ধগামী এবং তা চৈনিক ঋণ গ্রহীতা দেশগুলির কাছে বিপদের সংকেত পাঠাচ্ছে।