Column

Economic aspects of Bangladesh-India relations

Economic aspects of Bangladesh-India relations

Bangladesh Live News | @banglalivenews | 07 Feb 2019, 05:22 am
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমাগতভাবে আশ্চর্যজনক উন্নতিলাভ করেছে। এই সম্পর্ক এখন এমন এক অসাধারণ উচ্চতায় উঠেছে যে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা দুই প্রতিবেশী দেশের সম্প্রর্ককে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাছে এক রোল মডেল হিসেবে অভিহিত করেছেন।

এই দুই দেশ শুধু যে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছে তা নয়, সুরক্ষা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, ব্যবসা ও লগ্নি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও শক্তি, মহাকাশ, উন্নয়নমূলক প্রকল্প, সংস্কৃতি এবং মানুষে মানুষে সংযোগ- সমস্ত বিভাগেই তাদের সম্পর্কেকে গভীর করেছে।

 

অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের একটি অন্যতম স্তম্ভ। দুই দেশই চেষ্টা করছে সড়ক, রেল এবং সমুদ্রপথের মাধ্যমে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত হতে। এই যোগাযোগ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সংগে বাংলাদেশের বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ভারতের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে সড়ক এবং রেল ট্রানজিটে আগ্রহী, কেননা তা করতে পারলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে পণ্য পরিবহনের খরচ এবং সময় কমবে।

 

বাংলাদেশ এবং ভারত যে গুরুত্বপূর্ন উদ্যোগগুলি নিয়েছে তার মধ্যে আছে উত্তর-পূর্ব ভারতে ট্রানজিটের সুবিধার ব্যবস্থা করা, এবং বি বি আই এন (বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল)-এর অধীনে ভুটান, নেপাল এবং ভারতের সংগে উপ- আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

 

দ্য প্রোটোকল অন ইংল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড ( পি আই ডাবলু টি টি ) উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে কলকাতা-আসাম জলপথ পরিবহনের জন্য। এর ফলে পণ্য এবং পরিকাঠামো পরিবহনের সুবিধা হবে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে সে দেশের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরাতে খাদ্যশস্য জলপথে নিয়ে আসার অনুমতি দিয়েছে। ২০০৬ সালে আগরতলার উদ্দেশ্যে খাদ্যশস্য নিয়ে কলকাতা থেকে রওয়ানা হওয়া একটি জাহাজ যখন বাংলাদেশের আশুগঞ্জে পৌঁছোয়। সরকারিভাবে সেটাই প্রথম বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে উত্তর-পূর্বে যাওয়ার ট্রানজিট। একই সংগে সমুদ্রপথে এবং স্থলপথে ট্রানজিটের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ভারতকে। বাংলাদেশ টন পিছু ১৯২. ২২ টাকা হাড়ে   ট্রানশিপমেন্ট চার্জ করে।

 

দ্বিতীয় যোগাযোগ প্রকল্পটি হল ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত  বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া অ্যান্ড নেপাল মোটর ভেহিকলস এগ্রিমেন্ট (বি বি আই এন - এম ভি এ ) । এম ভি এ-র লক্ষ্য ভুটান, নেপাল এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে চট্টগ্রাম এবং কলকাতা বন্দরের সংগে যুক্ত করা। বি বি আই এন- এম ভি এ অনুযায়ী বাংলাদেশ এবং নেপাল ২০১৮ সালের ২৪শে এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে ভারতের অভ্যন্তর দিয়ে  দুই রাজধানীর মধ্যে বাস পরিষেবা চালু করেছে। ভুটান পার্লামেন্টে এম ভি এ অনুমতির অপেক্ষায় আছে। অনুমতি হয়ে গেলে এই সব দেশগুলির মধ্যে অসংখ্য যাত্রী এবং পণ্য চলাচল আশা করা যাচ্ছে। এই চুক্তি অনুযায়ী কলকাতা- আগরতলা- ঢাকা এবং ঢাকা -গুয়াহাটি - শিলং বাস পরিষেবা চালু হয়েছিল ২০১৫ সালে। বাংলাদেশ এবং ভারত উভয়েই খুলনা- কলকাতা এবং যশোর- কলকাতা রুটে নতুন বাস পরিষেবা শুরু করার কথা বিবেচনা করতে রাজি হয়েছে।

 

যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন বাড়িয়ে তুলতে বরাবর ব্যবহৃত পুরনো রেল রুটগুলিকে আবার চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে আটটি এ ধরনের পয়েন্ট আছে-দর্শনা-গেদে, বেনাপোল-পেট্রাপোল, রোহণপুর- সিঙ্গাবাদ, বিরল-রাধিকাপুর, শাহবাজপুর-মহিশাসন (২০০২ সাল থেকে বন্ধ), চিলাহাটি- হলদিবাড়ি (১৯৬৫ থেকে বন্ধ), বুড়িমারি-চ্যাংরাবান্ধা (১৯৭১ থেকে বন্ধ) এবং মোগোলহাট- গিতলদহ (১৯৭৬ সালে বন্ধ)।

 

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীদ্ব্য় যৌথভাবে  তিনটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এগুলি হল, বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউরা- শাহবাজপুর সেকশণ রিহ্যাবিলিটেশন, আখাউড়া- আগরতলা ডুয়াল গজ রেল কানেক্টিভিটি এবং চিলাহাটি- হলদিবাড়ি রেল কানেক্টিভিটি। ভারতের দেওয়া একটি সফট লোণের সাহায্যে খুলনা থেকে মঙ্গলা বন্দর অবধি একটি ৪৩ কিমি রেল লাইন পাতার কাজ হচ্ছে। এর ফলে মঙ্গলার সংগে স্থানীয় রেল রুটগুলির পাশাপাশি নেপাল এবং ভুটানের মত লাগোয়া  দেশগুলির সংগে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হতে পারবে। বাংলাদেশের সংগে ভারতের রেল যোগাযোগ করছে মৈত্রী এক্সপ্রেস এবং বন্ধন এক্সপ্রেসের মত প্যাসেঞ্জার ট্রেন।

 

বাংলাদেশ-ভারত কোস্টাল শিপিং এগ্রিমেন্টের উপর ভিত্তি করে ভারতের বন্দরগুলিতে যে শুল্ক নেওয়া হয়, তার উপর ৪০ শতাংশ ছাড় মিলবে যাত্রী এবং পণ্য জলযানগুলির ক্ষেত্রে।

 

বাংলাদেশ তাদের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার জন্য ভারতকে অনুমতি দিয়েছে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি নতুন রুট খোলা হয়েছে। সড়ক পথে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে লাগে ২০/২৫ দিন, কিন্তু এর ফলে সেই দূরত্ব আরও পাঁচ দিন কমবে। ভারতের সংগে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের  ক্ষেত্রে    পেট্রাপোল-বেণাপোল একটি গুরুত্বপূর্ন এবং ব্যস্ত দ্বার। এই চাপটাও কমবে।

 

বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য গত দশ বছর ধরে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ২৮.৫ শতাংশ বেড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৯ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। ২০১৭-১৮ সালের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.১৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট অথরিটির কাছে জমা পড়া ভারতীয় লগ্নি প্রস্তাব ৩ বিলিয়ন ডলার এবং তা উর্দ্ধমুখী। প্রথম তিন বছরে ভারত থেকে বাংলাদেশ আসা এফ ডি আই-এর পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে ২০১৪ সালের ২৪৩,৯১ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০১৭ সালে ৫১৬,৭১ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। যে সব ক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্থাগুলি বিনিয়োগ করেছে, তাদের মধ্যে আছে টেলিকম্যুনিকেশ্ন (এয়ারটেল), ফার্মাসিউটিকালস (সান ফার্মা), এফ এম সি জি (ম্যারিকো), অটোমোবাইলস (টাটা, হিরো মোটরস) ইত্যাদি।

 

বিদ্যুৎ এবং শক্তির ক্ষেত্রেও দুই দেশ তাদের সহযোগিতা বাড়িয়ে যাচ্ছে।

 

যদিও দু'দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতি একটি অনেক দিনের সমস্যা, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি একটি অসন্তোষের জায়গা। ভারতীয় নেতারা এই সংকেত দিয়েছেন যে নতুন দিল্লি এই বৈষম্য দূর করতে চেষ্টা করবে এবং ভারত সেই উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিচ্ছেও।

 

ভারতের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারত ৪৭ টি বাংলাদেশি পণ্যকে নেগেটিভ লিস্ট অফ ইমপোর্টসের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকেই ভারত তামাক এবং অ্যালকোহল বাদে অন্যান্য সব পণ্যকে শুল্কমুক্ত হিসেবে আসতে দিচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালে ভারত থেকে  বাংলাদেশেআমদানির  পরিমাণ ছিল ৮৬১.৮৪ বিলিয়ন ডলার, যেখানে রপ্তানি ছিল ৮৭.৩৩ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশ ব্যুরো অফ   স্ট্যাটিসটিক্স)।

 

এই বিশাল বাণিজ্যিক ঘাটতি কমাতে হলে বাংলাদেশের রপ্তানির উপর থেকে   বিভিন্ন ট্যারিফ এবং নন-ট্যারিফ সরিয়ে নিতে হবে। গত আট বছরে ভারত বাংলাদেশকে মোট ৮ বিলিয়ন ডলারের তিনটি লাইন অফ ক্রেডিট (এল ও সি ) দিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ সর্ববৃহত ভারতীয় এল ও সি গৃহীতা। ভারতীয় লগ্নিকারীদের জন্য বাংলাদেশ তিনটি স্পেশাল ইকনমিক জোনের ব্যবস্থা  করেছে মঙ্গলা, মিরেসরাই এবং ভেড়ামারায় এবং এই সব জায়গায় যথেষ্ট পরিমাণ ভারতীয় লগ্নী আশা করছে। এর ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি ভিত্তি প্রসারিত হবে।

 

এই দুই দেশ বিদ্যুৎ এবং শক্তির ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করে চলছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি দিকচিহ্ন। ২০১৬ সালে ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট ব্যান্ডউইড্‌থ আমদানি  শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা-জ্বালানির মৈত্রী থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট  গড়ে উঠছে।

 

দু'দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মধ্যে দিয়ে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ৫৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাঠানো শুরু হল। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি এবং দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মধ্যে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের নির্মানকার্যেরও উদ্বোধন করেন তাঁরা। এই পাইপলাইন দিয়ে বাংলাদেশ আসবে ডিজেল। বর্তমানে বাংলাদেশ এই ডিজেল আসে ট্রেনে-আসামের নুমালিগড় রিফাইনারি থেকে।

 

শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বাংলাদেশ-ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি বৃহৎ লক্ষ্যে পৌঁছেছে। এই বিশ্বায়নের যুগে দুই প্রতিবেশী'দেশের উন্নয়নের জন্য  জোরদার অর্থনৈতিক সম্পর্ক অতি জরুরি।