Column

Plight of Bengali Muslims in Pakistan

Plight of Bengali Muslims in Pakistan

Bangladesh Live News | @banglalivenews | 15 Nov 2019, 03:13 am
পাকিস্তানে মোটামুটি তিরিশ লক্ষ বাঙালি বাস করেন, তাঁদের অনেকেই করাচিতে। পাকিস্তানি সমাজের দরিদ্রতম অংশ এঁরা। অধিকাংশই 'বিদেশি' তকমা নিয়ে সে দেশে চরম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বাস করছেন।

 খুব কম বাঙ্গালি , যাদের সংখ্যা নগণ্য, পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে সরকারি কাগজপত্রে স্বীকৃত। উসমান টাউনের বাঙালি পাড়া এমনই একটি অঞ্চল, যেখানে বাঙালিরা ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন।  প্রকৃতপক্ষে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হবার সময় থেকেই সেখানে থাকছেন তাঁরা। তবুও বহু সমস্যার মধ্যে আছেন এঁরা, নিরন্তর দুশ্চিন্তা এবং হয়রানির  মধ্যে বাস করে। 

 

ন্যাশনাল এলিয়েন্স রেগুলেটরি অথরিটি (এন এ আর এ ) এবং পাকিস্তানি পুলিশ  এঁদের হেনস্থা, হয়রানি করে কারণ পাকিস্তানি নাগরিকত্বের দাবির স্বপক্ষে কোনও নথি অথবা প্রমাণ এঁদের কাছে নেই। আবার পাকিস্তানি নাগরিকত্বের পরিচয়পত্রের জন্য নারার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে পরিকল্পিতভাবে সমস্যা সৃষ্টি করে এই সব মানুষদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যে সব শর্ত পূরণের জন্য জোর করা হয়, তার ক্ষমতা এই সব দরিদ্র মানুষগুলির নেই। এঁদের ঠিক মত পরিষেবা দেওয়ার কথা যাদের, সেই নারা থেকে ঘুষ দাবি করা হয়। দিতে না পারলে প্রায়শই জেলে পুরে দেওয়া হয় অবৈধ বসবাসকারী- এই অভিযোগে।

 

হাসপাতাল এবং অন্যান্য চিকিৎসাকেন্দ্রগুলির মত জনপরিষেবা কেন্দ্রগুলি থেকে বাঙালি পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে দেওয়ার বহু কাহিনী খুবই শোনা যায় । সরকারি সিলমোহর লাগানো পাকিস্তানি ন্যাশনাল আইডেনটিটি কার্ড (এন আই সি ) থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বাঙালি বংশদ্ভূত বলে চিকিৎসা করানোর সুযোগ না দিয়ে বাঙালিদের হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার বহু ঘটনা রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরে বহু বাঙালি পাকিস্তান ছেড়ে বাংলাদেশে চলে গিয়েছিলেন। আশির দশকে তাঁদের অনেকে আবার একটু বেশি সুযোগ সুবিধার আশায় পাকিস্তানে চলে আসেন। তাঁদের মধ্যে অতি অল্প কয়েকজনই পাকিস্তানি এন আই সি জোগাড় করতে পেরেছেন।
.

১৯৮০ তে পাকিস্তানে আসা অভিবাসীদের দুর্দশা নিয়ে ইউ এন হিউম্যান রাইটস কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল একটি সরেজমিন সমীক্ষা করে। তাতে দেখা যায়, পাকিস্তানে থাকা ৩. ৫ মিলিয়ন অভিবাসীদের মধ্যে ২.২ মিলিয়নই থাকে করাচিতে, যাদের ৯০ শতাংশ আবার বাংলাভাষী। এই প্রতিনিধিদলের সংগে দেখা হয় মুজাফফর আলি নামে এক ব্যক্তির, যাঁর কাছে পাকিস্তানি নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণপত্র ছিলনা। তাঁর কাছে একমাত্র যা ছিল, তা হল ১৯৬৬ সালে ঢাকা থেকে করাচিতে যাওয়ার জাহাজের একটি টিকিট। "জীবিকার খোঁজে আমি আমার বাড়ি, আমার পরিজনদের ছেড়ে এসেছিলাম। পাকিস্তান পৌঁছানোর পর থেকে আর ঢাকা ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। আমার পরের তিন পুরুষের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এই করাচিতে হলেও এখনও আমি কোনও ন্যাশনাল আইডেনটিটি কার্ড পাইনি। পুলিশের ভয়ে আমি কখনও এই মাচার কলোনির বাইরে যাইনা। ওরা সবসময় বাঙালিদের ধরার তালে থাকে," বলেছিলেন এই ৬৫ বছরের ব্যক্তি।

 

মাচার কলোনি, যা মুহাম্মদি কলোনি নামেও পরিচিত, করাচির একটি অন্যতম ঘনবসতিপূর্ন বস্তি অঞ্চল, যেখানে দু'লক্ষের বেশি বাংলাভাষী মুসলমান থাকেন। যে ১১৬ টি অঞ্চলে করাচির বাঙালি অভিবাসীরা থাকেন, তার একটি এই কলোনি। "বাঙালিরা এখানে সর্বক্ষন ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করেন। শহরে ঘুরে বেড়ানো পুলিশ প্রতি কোনা থেকে বাঙালিদের ধরে," জানিয়েছেন ডঃ আলাদীন, মাচার কলোনির প্রাক্তন ইউনিয়ন কাউন্সিল নাজিম (প্রধান)। "কেন আমি নিজেকে বিদেশি বলে নথিভুক্ত করাবো ? আমি করাচিতেই জন্মেছি," বলেছে ২৫ বছরের নুর-উল-হাসান। "আমি বাঙালি বলে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল," বলেছে শামসুদ্দিন, যার বয়স এখন চল্লিশের ঘরে। নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে  পুরনো একটি আইডেনটিটি কার্ড দেখিয়ে সে বলেছে, এই কার্ড থাকা সত্ত্বেও পুলিশ আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফরেনার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী দু'মাস জেলে পুরে রেখেছিল। এর কারণ আমি বাঙলা বলি।"

 

"পবিত্র কুরানের নামে শপথ করে বলছি, "আমি পাকিস্তানে জন্মেছি, আমি একজন পাকিস্তানি, আমার বাবা এবং আমার ছেলেরা পাকিস্তানি। কিন্তু বাঙালি হওয়ার জন্য আমার সাথে সবসময় বৈষম্য করা হয়েছে, " বলেছে আবদুল রহমান, করাচির বস্তিগুলোয় থাকা তিরিশ লক্ষ বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষগুলির একজন।

 

তার সরল কথাগুলি থেকে জানা যায় পরিচয়ের খোঁজে জীবনযুদ্ধে লড়তে থাকা একটি প্রজন্মের বুকভাঙ্গা কাহিনী। "বাংলাদেশ গঠনের বিরোধিতা করা মুসলিম লিগ এবং জামাত-এ-ইসলামিকে সমর্থন করেছিলাম আমরা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলার সময় তাই   আমরা টার্গেট হয়ে পড়ি। ইসলামি উদ্দীপনা এবং উৎসাহের বশে আমরা দেশ থেকে পালিয়ে এখানে চলে আসি। কিন্তু এখানেও আমাদের একই অবস্থায় পড়তে হয়েছে। এবার আমাকে বলুন, কোথায় যাব আমরা ?" আবদুল, করাচির উপকূল শহর কোরাঙ্গির একজন বাসিন্দা, জানিয়েছে যে, পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে তাদের সঙ্গে আচরণ করা হলেও তাদের কেউই আর বাংলাদেশে ফিরে যেতে চায়না। বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে যারা পালিয়ে পাকিস্তানে চলে এসেছিল, তাদের বড় সমস্যা হল এই যে, তাদের পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশ- কোনও দেশেরই বৈধ কোনও কাগজ নেই।

 

পাকিস্তানে দশকের পর দশক বাস করেও এবং পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তানে উদ্ভূত হলেও তাদের বিদেশী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে এবং পাকিস্তানি বলে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছেনা। এখন তারা বাংলাদেশেও ফিরতে পারবেনা, কারণ তারা সেই দেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল এবং ঘর ছেড়েছিল সরকারিভাবে বাংলাদেশের জন্মের আগেই।

 

যে সব বাঙালি ১৯৭৪ সালের আগে পাকিস্তানে চলে এসেছে, তাদের জন্য পাকিস্তান সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে জানিয়েছে যে সে দেশে থাকার প্রমাণ দাখিল করে নাগরিকত্ব চাওয়ার অনুমতি তাদের দেওয়া হোল। যে সব অভিবাসী দেশে ১৯৭৪ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ঢুকেছে, তারা নাগরিকত্বের অধিকারী নয়। তবে তারা পাকিস্তানে কাজকর্ম করার রেজিস্ট্রেশন এবং অনুমতি চাইতে পারে। নারার নিয়ম অনুযায়ী, যে সব অবৈধ অভিবাসী ২০০ সালের ১০ই জুলায়ের পরে পাকিস্তানে ঢুকেছে, তাদের পাকিস্তানে কাজ অথবা ব্যবসা করার কোনও অধিকার নেই। তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা।