Column

Time to be Aware of China

Time to be Aware of China

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) | @banglalivenews | 31 Aug 2020, 01:39 am

আমি জ্যোতিষ অথবা ভাগ্য গণনায় বিশ্বাস করিনা, তবে রাজনীতির একজন ভাষ্যকার হিসেবে কখনও কখনও অবশ্যই সে বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার তাড়না বোধ করি।

আমার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হলে আনন্দিত হই বটে, তবে তার মানে এই নয় যে, না মিললে আমি অখুশি হব। যে সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী যুগের চরমতম স্বাস্থ্যসংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে আজকের পৃথিবী, সেই সময়ে কিছুটা নৈরাশ্যবাদী এবং দূর্বলমনা হয়ে পড়াটা স্বাভাবিক। চারপাশে যা সব ঘটছে, তা দেখে মনে আরও নিরাশা জাগে এবং আমার দেশ, বাংলাদেশের কথা ভেবে হতাশ বোধ করি। অতীতে বহু বারই ইতিহাসকে ভুলে যাওয়া হয়েছে অথবা তাকে বিকৃত করা হয়েছে, তবু আমরা এখনও সেই ইতিহাসকে কোনও না কোনও ভাবে অসম্মান করেই চলছি এবং অতীত থেকে কোনও রকম শিক্ষাই নিচ্ছিনা।

আমি যে এ রকম নিরাশাবাদীর মত কথা বলছি তার কারণ, ৩১শে অগাস্ট এগিয়ে আসছে। কেন এই তারিখটি তাৎপর্যপূর্ন ? ১৯৭৫ সালে এই দিনটিতেই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সেই সময় বিদেশে থাকা তাঁর দুই কন্যাকে বাদ দিয়ে সমগ্র পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যার ১৬ দিন পরে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সময় দেখে মনে হয় চিন যেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আধুনিক বাংলাদেশের রূপকারের মৃত্যুরই অপেক্ষা করছিল। এই স্বীকৃতির সঙ্গে যে সময়ের নির্মম অনুষঙ্গ রয়েছে, তা কোনও বাংলাদেশী নাগরিকের কখনও বিস্মৃত হওয়া উচিৎ নয়।

আজকের বাংলাদেশীরা, বিশেষত তরুণেরা, যারা দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফল ভোগ করছেন, তাঁদের এ কথা ভুললে চলবেনা যে এই চিনের তৈরি বুলেট দিয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানি সেনারা নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যা করেছিল। অতীতকে ভুলে যান, তাকিয়ে দেখুন কী ঘটছে এই শোকের মাসে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ই অগাস্ট তারিখে চিনা দূতাবাস থেকে শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে খালেদা জিয়াকে উপহার পাঠানো হয়েছে। আমি শুনেছি যে তাঁর নাকি তিনটি জন্মতারিখ আছে। একজন মানুষ, যাঁর দল এই ৩১শে অগাস্টেই চিনের সঙ্গে অবিশ্বাসের ভিত্তির উপর বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল, তাঁকে এই শোকের মাসে এমন স্বীকৃতি দেওয়ার থেকে বড় অকূটনৈতিক কুফল আর কিছু হতে পারেনা।

আজ সেই চিনই বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং সম্পর্কের কথা বলছে। এ কথা উল্লেখ করতে আমার ভোলা উচিত নয় যে, ১৯৭৫ সালের ৩১শে অগাস্টের আগে পাকিস্তানের প্ররোচনায় ইউনাইটেড নেশনসনের সদস্য হিসেবে চিন বারংবার� রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করেছিল।

 

চিন এ কথা বলতেই পারে যে ১৯৭৫ সালে যা ঘটেছিল, তা আজকের পরিস্থিতির থেকে আলাদা এবং এখনকার চিন অন্য রকমের। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, রাষ্ট্রচরিত্র পালটায়। নির্বাচন হয় এবং নতুন সরকার আসে। আমরাও এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি এবং প্রতিটি সরকারই তার নিজের রাজনৈতিক অগ্রাধিকার, ইতিহাসের বিচারবোধের উপর ভিত্তি করে তার নীতি নির্ধারন করে এবং দেশের প্রশাসনের কাজকে সে ভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

কিন্তু মনে করিয়ে দেওয়া যাক যে চিনের ব্যাপারটা সেরকম নয়। এখানে ৭০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা কম্যুনিস্ট পার্টির একনায়কতন্ত্র চলছে। চিন এই অজুহাত দিতে পারবেনা যে সেই সময় দেশে একটি অন্য সরকার ছিল। এর কারণ, গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের জন্মলগ্ন থেকেই সেখানে চিনের কম্যুনিস্ট পার্টির নিরবচ্ছিন্ন শাসন চলছে। এটি একটি একদলীয় একনায়কতন্ত্র,যেখানে শুধু নেতাদের বদল হয়, কিন্তু প্রশাসনিক নীতির ক্ষেত্রে এক সময় থেকে অন্য সময়ের মধ্যে কোনও মূলগত পার্থক্য থাকেনা।

কোভিড ১৯ এর মহামারীর একটি অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ফল হল এই যে, এই ভাইরাস যত দ্রুত সংক্রমণ ঘটাচ্ছে, তার থেকেও তাড়াতাড়ি বন্ধু হারাচ্ছে চিন। প্রথম থেকেই চিন য়ুহানে সংক্রমণ বিস্তারের খবর চাপা দিতে চেষ্টা করেছে। আজ পৃথিবীতে সম্পূর্ন একা হয়ে যাওয়া বান্ধবহীন চিন হঠাৎ করে বাংলাদেশের একান্ত বন্ধু হবার চেষ্টা করছে।

অস্ট্রেলিয়া, ইউ কে-র মত এক সময়ের বন্ধুরাও আগ্রাসী এবং আক্রমণাত্মক চিনের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে।

কোভিড সামলানোয় চিনের যে ভূমিকা এবং তার পরবর্তীতে তার আক্রমণাত্মক রূপ, সমুদ্র সীমানা নিয়ে বিসংবাদ, ক্রমেই প্রশ্নের মুখে পড়া তার 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট' নীতি, তার ঋণের ফাঁদে ফেলার কূটনীতি এবং তার 'উলফ ওয়ারিয়র' অথবা যুদ্ধং দেহি কূটনীতিকদের জন্য চিনের তথাকথিত শান্তিপুর্ন জাগরণ নিয়ে বিশেষ সন্দিহান সারা পৃথিবী।

ইউ কের গার্ডিনাতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, চিনে পার্টির উচ্চমার্গ থেকে বিতাড়িত হওয়া নেতা কাই শিয়া নাকি বলেছেন যে দেশের প্রেসিডেন্টের লাগামছাড়া ক্ষমতাই চিনকে 'সারা বিশ্বের শত্রু' করে তুলেছে। গত কয়েক মাস ধরেই আমরা দেখছি যে চিন যে ভাবে চলছে, তা আর যাই হোক, শান্তিপূর্ন নয়। ইন্দো-চিন সীমান্তে আমাদের প্রতিবেশী অঞ্চলে আমরা ২০ জন সৈনিককে হত্যা করতে দেখেছি।

 

 

সেই বীর সেনানীদের মৃত্যুতে আমি শোক জানাই। ভারত, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনসাধারণের কাছে উত্তর দিতে বাধ্য থাকে, সমস্ত শহিদ সেনানীর নাম প্রকাশ করে তাঁদের প্রাপ্য বীরোচিত সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। সেখানে চিনের একনায়কেরা তাদের দিকের মৃত অথবা আহত সৈনিকদের এমন কি নামও প্রকাশ করেনি। এ রকম বড় মাপের একটি সংঘর্ষে শুধুমাত্র এক দিকেই হতাতত হয়েছে, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।

আজ চিন নিজেকে বাংলাদেশের বড় বন্ধু বলে দাবি করছে। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকদল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল, আজ যে ভাবে চিনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করছে এবং তাও 'মুজিব বর্ষ' হিসেবে উদযাপিত হওয়া এই তাৎপর্যপূর্ন বছরটিতে, তা আমাকে চরম বিস্মিত করেছে। ইতিহাসকে কি আমরা সম্পূর্ন ভুলে গিয়েছি ? প্রকল্প এবং পরিকাঠামোয় বৈদেশিক লগ্নি আনার তাড়নায় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সম্পর্কের পিছনে কোনও নীতিই কি আর অবশিষ্ট নেই ? যে অগাস্ট মাসে আমরা আমাদের রাষ্ট্রের পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে শোক জানাচ্ছি এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, সেই সময়েই আমি আন্তরিকতার সঙ্গে এই প্রশ্নটি করছি।

 

ভবিষ্যদ্বাণীর কথায় ফিরে আসি। আমার যেন মনে হচ্ছে, ৩১শে অগাস্ট তারিখে, যে দিন চিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল, সে দিন দেশের কিছু রাজনৈতিক মহল ইতিহাসকে সম্পূর্ন ভুলে গিয়ে নির্ল্লজ্জভাবে এই দিনটি পালন করবে। আশা করব, এই বার আমার ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ন ভুল প্রমাণিত হবে।
_______________________________________________________________________________

লেখক বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপেলেট ডিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি