Column

বি এন পি এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম

বি এন পি এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম

Bangladesh Live News | @banglalivenews | 13 May 2019, 06:56 am
১৯৭৯ সালে জন্মলগ্নের সময় থেকেই দেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে বি এন পি দোদুল্যমান থেকেছে এবং ১৯৭১ সালে যে গণহত্যার বলি হয়েছিলেন তিরিশ লক্ষ মানুষ, ধর্ষিতা হয়েছিলেন আড়াই লক্ষ মহিলা, সে ব্যাপার নিয়েও এই দল কোনওদিনই কোনও কথা তোলেনি।

 প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় থেকে অভ্যুত্থানে নিহত হওয়া পর্যন্ত বিএনপি-র প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রশাসনিক জীবনের দিকে তাকালেও দেখা যায় যে মে, ১৯৮১-তে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার আগে অবধি  সমস্ত সময়েই তিনি দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন।

 

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গুঁড়িয়ে দিতে যে জামাত এবং অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী ইসলামি দলগুলি দখলদারি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তি যোদ্ধাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিল, তাদের নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং সেই নিষেধাজ্ঞা ১৯৭৬ সালে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর। তার ফলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের মূল চক্রী গুলাম আজম সহ সমস্ত পাকিস্তানপন্থি এবং দেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি, যারা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল পাকিস্তানে, সুযোগ পেল দেশে ফিরে আসার।

 

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর  যুদ্ধাপরাধীদের, বিশেষত গণহত্যা, ধর্ষন, ধ্বংসের তান্ডব চালানোর মত দানবিক কাজকর্মে পাক বাহিনীকে সরাসরি সহায়তা করা জামাতের মত সংগঠনগুলির শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান । এই লক্ষ্যে কোলাবরেটরস অ্যাক্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং কয়েক জনকে দোষীও সাব্যস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সব কিছুই ব্যর্থ হয়ে যায় জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করার পর। দশ হাজারের বেশি যুদ্ধাপরাধীকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধ করে দিয়ে ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।  কোলাবরেটরস অ্যাক্ট তুলে দেওয়া হয় এবং যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে সামরিক একনায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের সংবিধানেরও সংশোধন করেন। আর এই ভাবে পাকিস্তানপন্থী    সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পুনপ্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া হয় দেশের মাটিতে। জিয়াউর রহমান ইসলামি শক্তিগুলি, বিশেষত যারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় স্পষ্টত বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, তাদের সমর্থন পান।

 

সুপরিচিত পাক সহযোগীদের আবার জায়গা করে দেওয়ার জন্য সর্বোতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যতদিন পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন, ততদিন এই সব ব্যক্তিকে দু হাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বিলিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান। সুপরিচিত রাজাকার এবং মুসলিম লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমানকে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। এই শাহ আজিজুর রহমান ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে  রাষ্ট্রসংঘে একটি পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে  বাংলাদেশে চলতে থাকা মুক্তি যুদ্ধকে 'ইসলামি সৌভ্রাতৃত্বে ফাটল ধরাতে ভারতীয় চক্রান্তের ফল' বলে বর্ননা করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তিনি বলেছিলেন 'ভারত- প্ররোচিত দুষ্। স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর শাহ আজিজুর রহমান ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানেই বাস করেন এবং বাংলাদেশ যাতে কূটনৈতিক স্বীকৃতি না পায়, তার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলির কাছে দরবার করতে থাকেন।  

 

.আরও একজন  পাকিস্তানপন্থী নেতা,  জিয়াউর রহমান যার দরাজ পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, জামাতের পাক্তন প্রধান গুলাম আজম- পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পন এবং বাংলাদেশেরস জন্মগ্রহণের পরেও যার বাংলাদেশবিরোধী কাজকর্ম এমন কি এখনও পর্যন্ত মানুষকে ধাঁধায় ফেলে দেয়। এই ব্যক্তি ১৯৭২ সালে লন্ডনে গিয়ে পূর্বপাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করে বাংলাদেশবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়েছিলেন। লন্ডনে তিনি সোনার বাংলা নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করে সেখানে নিয়মিতভাবে এই প্রচার চালান যে "পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের হত্যা করার হচ্ছে এবং  ভারতের হিন্দুরা মসজিদ, মাদ্রাসাগুলি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।"

 

শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী কাজকর্মের জন্য গুলাম আজমের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিলেন। কিনুত সেই সেই নাগরিকত্ব আবার তাঁকে ফিরিয়ে দেন খালেদা জিয়া, ১৯৯৪ সালে।

 

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান-প্রতিষ্ঠিত বিএনপি-র অবস্থান তাই এখনও একই রকম আছে, এবং তা আরও স্পষ্ট হয়েছে শাপলা চত্বরকে হিফাজত-এ-ইসলামের জঙ্গিদের অবরোধ থেকে মুক্ত করতে যে ব্যবস্থা দেশের নিরাপত্তা কর্মীরা নিয়েছিলেন, তাকে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া 'গণহত্যা' বলে বর্ননা করায়।

 

গণহত্যা বা 'জেনোসাইড কথাটি  ব্যবহার করা হয় অতি ব্যাপক হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে, যেমন ঘটেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। ঢাকায় ২০১৫ সালে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে একটি জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে খালেদা জিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মৃতের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বোঝাতে চান যে সংখ্যার কথা  বলা হয়, তা অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করার এ এক সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা। যে ব্যক্তি দুবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর মুখ থেকে এই কথা শুনে গোটা জাতি তীব্র আঘাত পেয়েছে।

 

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দোষী প্রমাণিত জামাতের কিছু শীর্ষ নেতার শাস্তির আদেশের বিরুদ্ধে জামাত এবং তার ছাত্র শাখা ইসলামি ছাত্র শিবির দেশজুড়ে হিংসার তাণ্ডব নামিয়ে আনার পরেও   খালেদা জিয়া মৌন থেকেছেন। নীরবতা বজায় রেখে বি এন পি আসলে দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছে।  বি এন পি বরাবরই পাকিস্তানপন্থী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে থেকেছে এবং তা-ই থাকবে। তবে প্রকাশ্যে জামাতের স্বাধীনতাবিরোধী কাজকর্মকে সমর্থন জানিয়ে তারা জনগণের বিরাগভাজনও হতে চায়নি। বি এন পি এবং জামাত- এই দুটি দলই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-উদ্দীপনাকে হেয় করে দাবিয়ে রাখতে চায়।

 

বি এন পি এবং জামাত উভয় দলই ধর্মঘটের সময় প্রতিবাদের নামে ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের রায় অমান্য করে সুপরিকল্পিত হিংসা সংঘটিত করেছিল। দু দলই দেশে ধর্মঘট ডেকেছিল এবং ভাঙচুর চালিয়েছিল। দু দলই  হাত মিলিয়ে    দেশজুড়ে  হিংসাত্মক কাণ্ডকারখানা ঘটিয়েছিল।

 

খালেদা জিয়া জামাতকে শুধুমাত্র মিত্র হিসাবে বরন করেন নি, ২০০১ সালে সরকার গঠনের সময় তিনি এই দল থেকে বেশ কয়েকক জনকে মন্ত্রীও করেছেন। জামাতের আমির মতিউর রহমান নিজামই এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মহম্মদ মোহাজীদের মত   যুদ্ধাপরাধী এবং ধর্ষকদের সংগে ক্ষমটা ভাগাভাগি করতে তিনি দ্বিধা বোধ করেননি। খালেদার মন্ত্রীসভায় এদের ক্যাবিনেট মন্ত্রী করা হয়েছিল। এ ধরনের লজ্জাজনক ঘটনা কোনও সভ্য দেশে কখনও ঘটেনি। স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংস করতে যে সব জঘন্য অপরাধ তারা করেছিল, তার জন্য যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে  যুদ্ধাপরাধী এই দুই প্রাক্তন মন্ত্রীরই পরে ফাঁঁসির হুকুম হয়েছে।

 

যে সময় যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে দেশে, তখন সেই স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষ নিয়ে নিজেদের ইতিহাসেরই বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে জামাত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি দেশের জন্মের সংগে সম্পর্কযুক্ত অতি পুরাতন একটি দাবি।   

সর্বশেষ শিরোনাম

বাংলাদেশে পশ্চিমের ‘গণতান্ত্রিক বিতর্কের’ শূন্যতা Tue, Jan 02 2024

হাসিনার ১৫ বছর: আঞ্চলিক সহযোগিতা ও প্রবৃদ্ধির একটি অনুকরণীয় গল্প Thu, Dec 07 2023

বাংলাদেশ: পাকিস্তানের ছায়া থেকে পরিপক্ক গণতান্ত্রিক দেশ Fri, Dec 01 2023

ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মতন্ত্র: বাংলাদেশ - এবং পশ্চিম - হুমকির মুখে Thu, Nov 16 2023

সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের সূচক - বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের তুলনা Tue, Jan 17 2023

বাংলাদেশে বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতি - ব্যাপক দুর্নীতি ও উগ্র ইসলামবাদ Sat, Nov 19 2022

বিডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনের বাইরে বাংলাদেশ Wed, Dec 08 2021

Manipulating institutions: The Chinese Way in Bangladesh Sat, Dec 04 2021

শিল্পদ্রব্যের গুনমাণ: কোথায় চীনের বিশ্বাসযোগ্যতা Tue, Sep 15 2020

চিন থেকে সাবধান হওয়ার সময় এখন Mon, Aug 31 2020