Column
বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল অনুসরণ করার পরামর্শ পাকিস্তানকে
খবর অনুযায়ী, ইমরান খান-নেতৃত্বাধীন তেহ্রিক-এ-ইন্সাফ পার্টি প্রশাসন চালানোর জন্য সুইডেনের মডেল অনুসরণ করার কথা ভাবছে। ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে সুইডেনে জাতীয় ঋণ এবং মুদ্রাস্ফীতির হার নিম্নতম এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যকর।
জয়গাম খান পাকিস্তানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন উন্নয়নের ব্যাপারে সুইডেন নয়, বাংলাদেশের আদর্শ নিয়ে চলুক পাকিস্তান। যে ভাবে বাংলাদেশে গত দু'বছরে বিপুল উন্নতি করেছে, ওই টক শোয়ে তার প্রশংসা করেছেন জয়গাম খান। ঢাকা এবং বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে তুলনা করে তিনি পাকিস্তানের দূর্বলতা ব্যাখ্যা করেছেন। বাংলাদেশের উন্নতির প্রশংসা করেছেন টক শো-তে অংশ নেওয়া অন্যান্য আলোচনাকারীরাও ।
জয়গাম এ কথাও বলেছেন যে, যদি পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী দেশের বিপুল দূর্নীতিসহ সমস্ত সমস্যার সমাধান করেও ফেলতে পারেন, তাহলেও উন্নয়নে বাংলাদেশের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পাকিস্তানের অন্তত দশ বছর সময় লাগবে। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পণ্য এবং পরিষেবার ক্ষেত্রে যেখানে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ এখন বছরে ৪০ বিলিয়ন ডলার, সেখানে পাকিস্তানের রপ্তানি মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলার। "ঈশ্বরের দোহাই, আমরা সুইডেনের মত হতে চাইনা, দয়া করে বাংলাদেশের মত করে গড়ে তুলুন দেশটাকে," তিনি বলেছেন। জয়গাম আরও বলেছেন, "ইমরান যদি দেশটাকে আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্তরে নিয়ে যেতে পারেন, তাহলে আমরা সবাই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব, অবশ্য সেটাও অসম্ভব।" টক শো- টির ভিডিও ক্লিপ সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়।
জয়গামের এই মন্তব্যের পরে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। যখন এ ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন তিনি পাকিস্তানকে বাংলাদেশের মডেলের হদিশ দিতে প্রস্তুত কি না, তিনি বলেন, "কেন নয় ? ওরা যদি কোনও রকমের সহযোগিতা চায়, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা ওদের (পাকিস্তান) সাহায্য করব।"
বহু ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি ব্লক (এল ডি সি ), অর্থাৎ কোনও উন্নয়ন না হওয়া দেশগুলির মধ্য থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি বাংলাদেশকে দিয়েছে রাষ্ট্রসংঘ। এর যোগ্যতামান অর্জনের জন্য যে তিনটি শর্ত আবশ্যিকভাবে পালনীয়, তার সব কটিই যথাযথভাবে করেছে বাংলাদেশ। এই তিনটি মাপকাঠি হল, গ্রস ন্যাশনাল ইনকাম (জি এন আই ), পার ক্যাপিটা হিউম্যান অ্যাসেটস ইনডেক্স (এইচ এ আই) এবং ইকনমিক ভালনারিবিলিটি ইনডেক্স। রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশ এখন আরও উপরের দিকে যাত্রা শুরু করতে পারবে। সম্পূর্নভাবে এল ডি সি -র ছাপ মুছে ফেলার জন্য ২০২১ এবং ২০২৪ সালে রাষ্ট্রসংঘেরএকই কমিটি বাংলাদেশের অগ্রগতির আরও দু'টি পর্যালোচনা করবে।
ইউনাইটেড নেশনস ইকনমিক অ্যান্ড সোশাল কাউন্সিলের নিয়মানুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার জন্য একটি দেশকে কিছু শর্ত পালন করতে হয়। এর জন্য মাথাপিছু আয় হতে হবে ১২৩০ডলার,যেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১৬১০ডলার।হিউম্যান রিসোর্সেস ইনডেক্স হতে হবে অন্তত৬৪,যেখানে বাংলাদেশের তা এখন ৭২ পয়েন্ট। বাংলাদেশের ইকনমিক রিস্ক পয়েন্ট এখন ২৫.২ শতাংশ। এই পয়েন্ট যদি ৩৬ ছাড়িয়ে যায়, তাহলে একটি দেশকে এল ডি সি গোত্রের বলা হয়। এল ডি সি- তালিকাভুক্ত দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম এই তিনটি মাপকাঠিতেই উত্তীর্ন হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশকে সারা বিশ্বে এখন বলা হচ্ছে 'অসম্ভব অভীষ্ট অর্জনের দেশ।' মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোলস(এম ডি জি)-এর কর্মসূচী নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য-মুক্ত সমাজ গড়ার পথে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছেছে। দেশে দারিদ্য হার কমিয়ে আনার এই অতীব উল্লেখযোগ্য সাফল্য বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরে। ২০২৫ সালের মধ্যে ক্ষুধা দূরীকরণের লক্ষ্যে নভেম্বর মাসে আমেরিকায় একটি বিশ্বব্যাপী উদ্যোগের সূচনা হতে চলেছে এবং সেই অনুষ্ঠানের 'ফোকাল কান্ট্রি' বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন কান্ট্রি ডিরেক্টর ইয়োহানেস জুট বলেছেন, "সমস্ত রকমের প্রতিবন্ধকার সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশ গত দশ বছরে এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য সীমার উপরে নিয়ে এসে অসাম্য কমিয়েছে। এটি একটি বিরল, উল্লেখযোগ্য সাফল্য।"
বাংলাদেশের প্ল্যানিং কমিশনের জেনারেল ইকনমি ডিভিশন মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোলসের যে চূড়ান্ত রিপোর্টটি ছাপিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়ঃ দারিদ্র্য হার কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে ভর্তির হার ৯৭ শতাংশ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ন আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনা পরিবর্তন হয়েছে দারিদ্র্যের ব্যাপারে। এই দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি । গত কয়েক বছরে দারিদ্র্য অপনয়ণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। এবং তা সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন পরিকল্পনা রূপায়ণের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে।
সরকারের আন্তরিক চেষ্টার ফলে ১৯৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত দারিদ্র্য ৬০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশে। এই সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের শতাংশ ১৩.৫-এ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সামান্য কয়েকটি দেশের অন্যতম, যারা মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সমর্থ হয়েছে।
জুলাই, ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক পার ক্যাপিটা গ্রস ন্যাশনাল ইনকামের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে নিম্ন-মধ্য (লোয়ার- মিডল) আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই আধুনিক ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজির ডিজিটাল ভার্সন আয়ত্ত করেছে। ই-কমার্স, ই-ব্যাংকিং, অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজ, প্রভৃতির প্রচলন ঘটিয়েছে এই সরকার। আই সি টি-কে ব্যবহার করে কৃষি, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোগ সহ সমস্ত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় উৎপাদনশীলতা অর্জন করার লক্ষ্যে এ-সবই একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ টিকতে পারবে কি না। যে বাংলাদেশকে 'টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট' বলা হত, সেই দেশ আজ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়ে অন্য দেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ন অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।