Column
শেখ হাসিনার বিজয়যাত্রা
বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে উপর্যুপরি তিনবার ক্ষমতারূঢ় হলেন। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার আশাকে বাস্তবায়িত করার সংকল্প তিনি করেছেন। যেখানে অতীতের বি এন পি - জামাত সরকার কার্যত সমস্ত চরমপন্থি ইসলামী দল এবং পাকপন্থী শক্তিগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল, এমন কি ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের একটি জনসভায় শেখ হাসিনার বক্তৃতা চলাকালীন গ্রেনেড আক্রমণ-কাণ্ডেও জড়িত ছিল, সেখানে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আবার ফিরে আসা ইসলামী চরমপন্থা-বিরোধী মানুষজনদের কাছে এক বিরাট স্বস্তির বিষয়।
সাম্প্রতিক সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল এ কথাই প্রমাণ করেছে যে, অনেক রকমের ত্রুটি এবং সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের পিছনে দেশের গরিষ্ঠ অংশের মানুষের সমর্থন রয়েছে এবং দলটি দেশকে তুলনামূলকভাবে একটি উদার মুসলিম-গরিষ্ঠ, গণতান্ত্রিক বিশ্বাসযোগ্যতাসম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে অবদান রেখেছে। বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার বাংলাদেশ সৃষ্টির দাবিদার এবং বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তির রচয়িতা আওয়ামী লীগকে এক অনন্য আত্মপরিচয় দান করেছে।
শেখ হাসিনার সাফল্য অলৌকিকের থেকে কিছু কম নয়। প্রায় শূন্য থেকে তিনি দেশের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। একটি অনুন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ যে আজ একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়ে উঠেছে, তা তাঁরই অবদানের ফলে। এর প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছিল তিনি প্রথমবার (১৯৯৬-২০০১) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময়েই। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর অনেক বছরের অবক্ষয় এবং বন্ধ্যাত্বের পরে এসেছিল সেই পর্ব। অবশ্য সেই সময় দীর্ঘায়িত হতে পারেনি বি এন পি - জামাত জোট ক্ষমতায় এসে যাওয়ায়। ২০০১ সালে থেকে পুরো পাঁচ বছর ধরে চলেছিল হিংসা, দূর্নীতি, ধর্মীয় উগ্রতা এবং জঙ্গিবাদের রাজত্ব। এরপরে আবার রক্ষাকর্তৃ হিসেবে আবির্ভূতা হলেন শেখ হাসিনা তাঁর দলের ইস্তাহার, চার্টার ফর চেঞ্জ -ভিশণ ২০২১ নিয়ে এবং ২৯শে ডিসেম্বর,২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতা সহ জিতে ক্ষমতায় আসেন। ২০১৪ সালে তিনি উপর্যুপরি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে দেশকে ফিনিক্স পাখির মত পুনর্জীবিত করেন। অনেক প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করে সেই পথ চলা এখনও চলছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন স্ফীত হয়ে চলেছে। এইচ এস বি সি -র বার্ষিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে ২৬ তম বৃহৎ অর্থনীতি হতে চলেছে। তার পিছনে থাকবে ফিলিপিন্স, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং মালয়েশিয়া। দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, বাংলাদেশ, ইজিপ্ট, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপিন্স, তুরস্ক এবং ভিয়েতনাম- এই এগারোটি দেশের একটি তালিকা করা হয়েছে, যারা ২১ শতাব্দিতে ব্রিক দেশগুলির (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না) পরে বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ কমনওয়েলথ, ডি -৮ এবং অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশেন, সার্ক, আই এম এফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হিসেবে এগিয়ে চলেছে। সমস্ত বৃহৎ বিরোধী শক্তির বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাহায্য ছাড়াই কী ভাবে পদ্মা সেতু নির্মান কাজ সম্ভব করা যায়, তা শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন।
শেখ হাসিনার এক বড় সাফল্য হল ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার সাহসী পদক্ষেপ। এই যুদ্ধাপরাধীরা এর আগে খালেদা জিয়ার সংগে ক্ষমতার অংশীদার ছিল এবং বি এন পি আমলে এদের হাতের মুঠোয় ছিল বিপুল রাজনৈতিক শক্তি। দেশের জনগণ, বিশেষত যারা একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে নিকট জনেদের হারিয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই সেই সব ঘৃণ্য অপরাধের পর কয়েক দশক কেটে গেলেও অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে খুশি হয়েছেন।
শেখ হাসিনা সেই বিরল প্রজাতির পরম সাহসী নেতা, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শকে বুকে নিয়ে অকুতোভয়ে প্রবল ঝঞ্ঝার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম-পরবর্তীয় অধ্যায়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করাই সব থেকে সাহসী উদ্যোগ। অভ্যন্তরীণ অথবা বৈদেশিক কোনও চাপের কাছে নত না হয়ে তিনি জাতির কাছে প্রতিশ্রুত দায়বদ্ধতা পূরণে এগিয়ে গেছেন।বাংলাদেশে বিচার প্রদানের ক্ষেত্রে এটি এক নতুন ইতিহাস, যা প্রমাণ করে যে মানবতার বিরুদ্ধে করা অপরাধ প্রতিকারহীন হয়ে থাকেনা। এই যুদ্ধাপরাধ বিচার নুরেমবার্গ ট্রায়ালস, টোকিও ট্রায়ালস এবং ম্যানিলা ট্রায়ালসের সমগোত্রীয়।
আর একটি যে সাফল্যের কৃতিত্ব শেখ হাসিনাকে দিতে হয়, তা হল, তাঁর সরকার জঙ্গি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এক নিরলস সংগ্রামে লিপ্ত। মুসলিম দেশগুলিতে এটি এক গুরুত্বপূর্ন সমস্যা। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার মত দেশগুলিতে এবং অন্যান্য জায়গায় চরমপন্থি শক্তিগুলি হাজারে হাজারে নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে। সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশও জঙ্গি শক্তিগুলির নিশানায় থেকেছে। ২০০১ সালে রমনা বটমূলের ভয়ানক বোমা বিস্ফোরণ, ২০০৪ সালের অগাস্টের গ্রেনেড আক্রমণ, ২০০৫, ১৭ই অগাস্টে দেশজুড়ে এক সংগে বোমা বিস্ফোরণ এবং সর্বশেষ, ২০১৬ সালের ১লা জুলাই গুলশন কাফের ঘটনা বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিপনার অস্তিত্বের কথাই বলে। সমাজের এই সব অশুভ শক্তিগুলের বিরুদ্ধে যদি শেখ হাসিনা আন্তরিক ভাবে না লড়তেন তাহলে এতদিনে তারা এমন জায়গায় পৌঁছত, যেখান থেকে আর ফিরিয়ে আনা যেতনা। এদের ব্যাপারে শেখ হাসিনা শক্ত নীতি অবলম্বন করেছেন, তাই তাঁর জঙ্গিবিরোধী ভূমিকা আদর্শ হিসেবে অন্যান্য মুসলিম দেশেও অনুসরনযোগ্য।
নারীর ক্ষমতায়ন শেখ হাসিনার আর এক অতি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। এই প্রথম বাংলাদেশে বহু সংখ্যক নারী উচ্চপদে আসীন রয়েছেন। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের কথায়, লিঙ্গ সমতা এবং ক্ষমতায়নের সমস্ত সূচকেই বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে। নারী ক্ষমতায়নের ব্যাপারে শেখ হাসিনা একটি জাতীয় নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই নীতি প্রণয়ন করে নারীদের সামাজিক এবং আইনি অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।
রাষ্ট্রব্যবস্থার একজন সফল পরিচালক হিসেবে তাঁর কৌশলী দক্ষতা দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলিকে ঘায়েল করে এবং উগ্রপন্থা ও বিচ্ছিন্নতার আশু বিপদগুলিকে দূর করে শেখ হাসিনা দেশে শান্তি এবং স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করেছেন। ধর্মীয় উগ্রতা এবং মৌলবাদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে চলে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সংবিধানের যে মূল নীতি- ধর্মনিরপেক্ষতা-তাকে সফল ভাবে তুলে ধরেছেন। বস্তুতপক্ষে, তাঁর শাসনকালে যে দীর্ঘ, নিরবচ্ছিন্ন স্থায়িত্ব, তা উন্নয়নের ব্যপারে অনুঘটকের কাজ করেছে।
রোহিংগিয়াদের নিয়ে বিপুল মানবিক ব্যাপারটি শেখ হাসিনার যে রকম অসাধারণ ভাবে সামলেছেন, তা তৎক্ষণাৎ প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং দেশের সীমানার বাইরে থেকেও তাঁর যোগ্য নেতৃত্বের স্বীকৃতি আদায় করেছে। বাংলাদেশে সাত লক্ষেরও বেশি রোহিংগিয়া শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা প্রকৃতপক্ষে মানবিকতার মূর্ত প্রতীক রূপে দেখা দিয়েছেন। সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা তাঁকে অসংখ্য উপাধি এবং খেতাব দিয়ে বিপদকবলিত মানবতাকে উদ্ধার করার ব্যাপারে তাঁর অসাধারণ অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়েছে। শিবিরে বাস করা এইসব বঞ্চিত মানুষগুলিকে আর একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার উপায় করে দিয়ে এবং তাদের সুযোগসুবিধা বাড়িয়ে তিনি তাঁদের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেনক। সুযোগসুবিধা না পাওয়া এবং বঞ্চিত এই সব মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার অবশ্বাস্য কঠিন কাজটি ছিল একটি মস্ত চ্যালঞ্জ এবং শেখ হাসিনা তা অতিক্রম করেছেন তাঁর একক নেতৃত্বগুণ এবং সাহসের মাধ্যমে।
শেখ হাসিনা এখন জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির প্রতীক হয়ে গেছেন। তিনি সেই শক্তির ধারক, যা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সমস্ত চক্রান্তের বিরুদ্ধে সজাগ। যারা বাংলাদেশকে এবং তার স্বাধীন সত্ত্বাকে ভালোবাসে, তারা দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সোনার বাংলা গড়ে তোলার যাত্রায় শেখ হাসিনাকে পূর্ন সমর্থন দেবে। এ কথা মানুষ যেন মনে রাখেন যে ঘৃণ্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জাতির জনককে হত্যা করেছিল তারা এখনও সামান্যতম সুযোগের অপেক্ষায় ওঁত পেতে আছে বাংলাদেশের এই ঈর্ষনীয় উন্নয়নকে আবার ধ্বংস করে দেবার জন্য।
সদ্যসমাপ্ত ১১ তম জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনার বিপুল জয় প্রমাণ করল এ তাঁর লক্ষ্য এবং প্রতিশ্রুতির স্বপক্ষে বিপুল নির্বাচনী রায়। চতুর্থবারের জন্য শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় নির্বাচিত করে মানুষ তাঁর উপর তাঁদের আস্থা রেখেছেন। এখন আওয়ামী লীগের দায় এই আস্থার মর্যাদা রাখা। এই বিপুল জয়কে উদযাপন করার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে সব শ্রেণীর মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা।
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দেশ, অঞ্চল এবং বিশ্বের পক্ষেও আবশ্যিক।