Column
কেন মানুষ ভোট দিয়েছেন আওয়ামী লীগকে
এই নির্বাচনকে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সব থেকে পরিচ্ছন্ন নির্বাচন বলে অভিহিত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মহল থেকে। ১৯৪৯ সালে জন্মলগ্ন থেকেই এই দল বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সব থেকে বিশ্বাসযোগ্য অগ্রদূত হিসেবে কাজ করে এসেছে এবং দেশকে তুলনামূলক ভাবে একটি উদার, মুসলিম-গরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে তার অবদান রেখেছে।
১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আওয়ামী লীগ তথাকথিত ইসলামি জাতীয়তাবাদী এবং পাকিস্তানপন্থী শক্তিগুলির হিংসাশ্রয়ী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। গণতন্ত্রের ধারনায় অবিশ্বাসী এই শক্তিগুলি চায় ধর্মের নামে যে কোনও মূল্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নেবার জন্য অতীতে প্রায়ই জোট বেঁধেছে সামরিক বাহিনীর বিশেষ অংশ, ভাড়াটে শক্তি এবং পাকপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি।
বি এন পি এবং জামাতের প্রতিনিধিত্বে এই দলগুলি সব সময়েই ধর্মকে একটি অতি সহজ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং তাই তারা একটি শক্তিশালী ইসলামী জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয়ের জন্য সওয়াল করে থাকে এবং মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতা বোধ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ভারতকে নেতিবাচক আলোকে দেখাতে চেষ্টা করে। ইসলামী জাতীয়তাবাদকে যে নিকৃষ্টতম রাজনৈতিক দূর্নীতির সুবিধার্থে ছদ্মবেশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, অতীতের বি এন পি-জামাত সরকার তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দুই পুত্র, যাদের একজন সম্প্রতি মারা গিয়েছেন, বহু লক্ষ ডলার বিদেশে পাচার করে দেশকে তছনছ করে দিয়েছেন।
অভূতপূর্ব গরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ উপর্যুপরি তিনবার ক্ষমতায় ফিরে এল সাম্প্রতিক যে নির্বাচনে, সেখানে তারা উন্নয়ন-বিষয়ক বিষয়গুলির উপরে বেশি করে জোর দিয়েছিল এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ধর্মীয় উগ্রতা এবং জঙ্গিবাদকে দমন করার । সুশাসন প্রদান করে এবং সার্বিক উন্নয়ন ঘটিয়ে গত দশ বছর ধরে এই দল যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ সুগম করেছে।
আওয়ামী লীগ শাসনের গত দশ বছরে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে এবং ৭.৮৬ শতাংশ জি ডি পি বৃদ্ধির হারে অন্যতম শীর্ষস্থানাধিকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর অর্থনীতিবিদদের কাছে এক প্রকৃত আবিষ্কার। দেশের মাথাপিছু আয় অথবা মানুষের গড় আয় তিনগুণ বেড়ে ১,১৭৫ ডলার হয়েছে। মুদ্রস্ফীতির হার কমিয়ে আনা হয়েছে ৫.৭ শতাংশে। দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রতিবেশী এবং অল্প আয়ের অন্যান্য দেশগুলিকে এ ব্যাপারে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। এই সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশ শুধু যে অনেক কিছু অর্জন করেছে তা নয়, দেশের প্রধান নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর কর্ম এবং দক্ষতার জন্য বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
নিজেদের অর্থেই পদ্মা ব্রিজ নির্মাণ এই সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করে তোলায় রপ্তানি আয় তিনগুণ বেড়ে এখন ৪১ বিলিয়ন ডলার, বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার বহুগুণ বেড়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলার। দেশে ১০০ টি ইকনমিক জোন স্থাপিত হয়েছে। গত দশ বছরে রেকর্ড সংখ্যক টেক্সট বুক- প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন- বিতরণ করা হয়েছে। প্রায় ২২ মিলিয়ন ছাত্র ছাত্রীকে দেওয়া হয়েছে স্কলারশিপ অথবা স্টাইপেন্ড। প্রাইমারি স্কুলগুলিতে ড্রপ আউটের হার কমেছে প্রবলভাবে এবং স্বাক্ষরতার হার বেড়ে হয়েছে ৭৩ শতাংশ।
সরকার বেশ কয়েকটি অতি বৃহৎ পরিকাঠামো প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে আছে পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলওয়ে, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামফল পাওয়ার প্রোজেক্ট, মেতাবারি পাওয়ার জেনারেশন সেন্টার, মেট্রো রেল এবং এল এন জি টার্মিনাল।
বাংলাদেশের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার উপরে রয়েছেন এবং বেকারির হার কমে দাঁড়িয়েছে চার শতাংশে । সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলির জন্য বহু হাজার কোটি টাকা খরচ করে তাদের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে বহু লক্ষ মানুষকে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা হয়েছে ২১.৩ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্য দশ শতাংশে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে গত দশ বছরে এই সরকারের সাফল্য অতীব অর্থবহ। বর্তমানে প্রতিদিনের বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬,০০ মেগা ওয়াট এবং লোড শেডিং অতীতের বস্তু। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়িয়ে নিয়ে গেছে ২০,১৩৩ মেগা ওয়াটে, যেখানে বি এন পি- জামাত আমলে তা ছিল ৪,৯৪২ মেগা ওয়াট।
তাঁর প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মায়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র-সীমানা বিরোধ এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্র ও স্থল সীমানা বিরোধ মিটিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট, বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করে বাংলাদেশকে তিনি মহাকাশে নিয়ে গেছেন।
এই সময়কালের মধ্যে সমস্ত ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ বিপুল অগ্রগতি ঘটিয়ে দেশকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক রোল মডেল করে তুলেছে। সমস্ত রকমের নৈরাজ্য, সন্ত্রাসবাদ এবং হিংসার ক্ষেত্রে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ করে সরকার রাজনীতিতে স্থায়িত্ব এনেছে। যখনই জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিতে চেয়েছে, তার ডানা ছেঁটে দিয়েছে সরকার।
রাস্তাঘাট, হাইওয়ে, ব্রিজ ইত্যাদির ব্যাপক উন্নয়ন এবং রেল পরিষেবায় অচিন্ত্যনীয় অগ্রগতি ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এই সরকার ৩৫০ কিমি নতুন রেললাইন, ৯১ টি স্টেশন ভবন, ৭৯ টি নতুন স্টেশন এবং ২৯৫ টি নতুন রেল ব্রিজ তৈরি করেছে গত দশ বছরে।
উগ্রবাদ এবং জঙ্গিবাদকে দূর করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে এবং বিদেশে মানুষের সম্ভ্রম আদায় করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা আর একটি উল্লেযোগ্য সাফল্য, যার দ্বারা দেশকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং পাকপন্থী লোকজনদের থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছেন।
এ কথা পরিষ্কার যে, ২০০১-০৬ সময়কার ভয়ানক দিনগুলিতে ফিরে যাবার জন্য বাংলাদেশের মানুষ কখনওই বি এন পি - জামাতের জোটকে ভোট দিতেন না। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর বি এন পি -জামাত কর্মীদের ঘৃণ্য আক্রমণ এখনও তাঁদের স্মৃতিতে আছে। বি এন পি রাজত্বের দূর্নীতি এবং হাওয়া ভবন থেকে খালেদা জিয়ার পুত্র তারিক রহমানের সমান্তরাল সরকার চালিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার কথা তাঁরা ভোলেন নি। ২১ শে অগাস্টের দুঃসহ স্মৃতি, জঙ্গিপনার উত্থান এবং রাজনীতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ - প্রগতিশীল মানুষ তথা সাংস্কৃতিক কর্মীদের একের পর এক হত্যার স্মৃতিও তাড়িয়ে বেড়ায় দেশের মানুষজনকে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে মানুষ সুস্পষ্টভাবে এই সংকেতই পাঠিয়েছেন যে, তাঁরা স্থায়িত্ব, অগ্রগতি এবং উন্নয়ন চান। বি এন পি - জামাত রাজত্বের দূর্নীতিকে পরিষ্কারভাবে খারিজ করেছেন তাঁরা এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ধর্ম এবং ইসলামি জাতীয়তাবাদের নামে রাজনৈতিক আবেদনে মোটেও উৎসাহী নন তাঁরা।