Column

তারিক রহমান ঃ এক নেতার চিত্র

তারিক রহমান ঃ এক নেতার চিত্র

| | 13 Mar 2018, 01:32 am
অনাথদের জন্য পাঠানো বিদেশি অনুদানের টাকা তছরুপের দায়ে বি এন পি-র চেয়ারপার্সন এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি একই মামলায় দোষী প্রমাণিত তাঁর বিদেশে পালিয়ে থাকা পুত্র তারিক রহমানের জন্যও তার অনুপস্থিতিতেই দশ বছর কারাবাসের আদেশ ঘোষণা করেছে বিশেষ আদালত।

বিস্ময়কর যে,   খালেদা জেলে যাওয়া মাত্রই বি এন পি-র  কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তারিক রহমানের নাম ঘোষণা করেছে দল। বিদেশে অর্থ পাচারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ২০১৬ সালে এই তারিক রহমানের বিরুদ্ধে সাত বছরের জেল এবং কুড়ি কোটি টাকা জরিমানার রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট।

 

{special_block_1}বি এন পি সম্প্রতি দলের সংবিধানের একটি অংশ বাতিল করে নিয়ম করেছে দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং অসৎ লোকেরা দলের নেতৃপদে থাকতে পারবেন না।

 

আরও সাতটি মামলায় তারিক রহমানের বিচার চলছে বাংলাদেশে। এগুলির একটি  ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভার উপর গ্রেনেড আক্রমণ সংক্রান্ত। এই ঘটনায় ২৩ জন নিহত হয়েছিলেন। আক্রমণের মূল লক্ষ্য শেখ হাসিনা সেই সময় সভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। অতি অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচেন তিনি।

 

অর্থনৈতিক প্রতারণা, দূর্নীতি, সন্ত্রাসমূলক কাজকর্ম এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য কারারুদ্ধ হবার ভয়ে লন্ডনে পালিয়ে থাকা তারিক রহমান অবশ্য প্রায়ই খবরের কাগজের শিরোনামে থাকেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সেই সংগে রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান সহ জাতীয় স্তরের নেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারের সুবাদে।

 

অর্থপাচার, তছরুপ, জোর করে টাকা আদায় এবং ঘুষ নেওয়ার বেশ কিছু ঘটনায় জড়িত তারিক। খালেদা জিয়ার শাসনকালে (২০০১-০৬)  তারিক তাঁর কিছু বিশ্বস্ত অনুচর এবং গুন্ডার সাহায্যে হাওয়া মহল থেকে প্রকৃতপক্ষে এক সমান্তরাল প্রশাসন চালাতেন।

 

তাঁর মা'র পদমর্যাদার সুযোগ নিয়ে তারিক দেশের মধ্যে সব থেকে ক্ষমতাবান এবং দূর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি যে চাল, চিনি, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অন্যান্য আবশ্যিক জিনিষপত্রের উপর অবৈধ ভাবে বসানো শুল্ক থেকে বিপুল মুনাফা করতেন, সে বিষয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছ। এও জানা গেছে যে, তিনি মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এবং সৌদি আরবে টাকা খাটিয়েছেন। তারিক এবং তাঁকে ঘুষ দিয়ে রাষ্ট্রের আয়ের ক্ষতি করে অন্যায় সুবিধা নিতে চাওয়া লোকেদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতেন দেশের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুতফোজ্জামান বাবর।

 

২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার শাসনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে সামরিক মদতে যে সরকার আসে, তাদের সময় প্রকাশ পায় গোপন লেনদেন এবং উৎপীড়নের মাধ্যমে তারিক বিপুল সম্পত্তি অর্জন করেছেন। অসৎ উপায়ে অর্জিত এই অর্থের জোরে বাংলাদেশের প্রথম দশজন ধনী ব্যক্তির মধ্যে স্থান করে নেন তারিক। সেই সময় তাঁর সম্পত্তির মূল্য ছিল একশো কোটি ডলার।{special_block_2}

 

২০০৯ সালে দূর্নীতি দমন সংস্থা অ্যান্টি করাপশন কমিশন তারিক এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ   ব্যবসায়িক সহযোগী গিয়াসুদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। ঢাকার একটি আদালতে চার্জ দাখিল করে এই সি সি -র অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর মহম্মদ ইব্রাহিম এই দু'জনের বিরুদ্ধে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ২০.৪১ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। বিভিন্ন সংস্থা এবং কোম্পানি থেকে এই অর্থ আদায় করেছিলেন তারিক। এই অর্থের বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হিসেবে নিজের প্রভাব খাটিয়ে এই সব সংস্থাগুলিকে বিভিন্ন কাজের বরাত পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। এই টাকা তোলার সময় নিজের পরিচয় গোপন রাখার উদ্দেশ্যে তারিক তাঁর বন্ধু মামুনের সিটি ব্যাঙ্ক সিংগাপুরের ইস্যু করা  একটি অতিরিক্ত ডেবিট কার্ড ব্যবহার করতেন।

 

যে পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে বলা হয়, তা ছাড়াও ওই একই অ্যাকাউন্ট থেকে ২০০৩ থেকে ২০০৭ -এর মধ্যে বিভিন্ন সময় তারিক তুলেছেন ৫৪,৯৮২ ডলার (৩৮.৪৯ লক্ষ টাকা) এবং মামুন ৭৯,৫৪২ ডলার (৫৫. ৬৮ লক্ষ টাকা)। তারিকের ডেবিট কার্ডের কথা এ সি সি জানতে পারে ২০০৭ সালের ৭ই জুন তাদের কাছে তারিকের জমা দেওয়া সম্পত্তির বিবৃতি থেকে।  এতে তারিক জানিয়েছিল যে তার সিংগাপুর সিটিব্যাংকের একটি ডেবিট কার্ড আছে। মামুন এই ধরণের কোনও ওয়েলথ স্টেটমেন্ট দেয়নি, কিন্তু জেরার মুখে সে  সিংগাপুর সিটিব্যাংক এবং ইউ কে-র ন্যা্টওয়েস্ট ব্যাঙ্কে তার অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ  থাকার কথা স্বীকার করে। তার স্বীকারোক্তির পর এ সি সি সিংগাপুর সিটিব্যাংকে রাখা ১.১৯ কোটি টাকার সমতুল ইউরো, ১৯.০২ কোটি টাকার সমতুল আমেরিকান ডলার এবং ১৯. ৫১ কোটি টাকার সমতুল পাউন্ডের সন্ধান পায়।

 

হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন পাওয়ার প্ল্যান্টের 'কনসালটেন্সি ফি' হিসেবে সিটিব্যাংক সিংগাপুরের সেই অ্যাকাউন্টে ২০০৩ সালের ১৬ই জানুয়ারি ১১.৬৭ লক্ষ ডলার (৮.২ কোটি টাকা) জমা করেছিলেন। ২০০৩ সালের ১লা অগাস্টে নির্মাণ কন্সট্রাকশনের চেয়ারম্যান খাদিজা ইসলাম সিংগাপুরের ও সি সি ব্যাংক থেকে পাঠিয়েছিলেন ৭.৫০ লক্ষ ডলার ( ৫.২৫ কোটি টাকা) । তাঁর সংস্থা টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়েট ক্ষমতাসম্পন্ন পাওয়ার প্ল্যান্টের কাজের বরাতের জন্য চেষ্টা করছিল। সিটিব্যাংক সিংগাপুরের ওই অ্যাকাউন্টেই সেই বছরের ২৬শে সেপ্টেম্বর ৩০,০০০ ডলার (২১ লক্ষ টাকা) জমা করেছিল এ মেয়ার সিয়ে - রি। এ ছাড়া নামহীন উৎস থেকে ঐ একই  অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছিল আরও ৪.১১ লক্ষ ডলার (২.৮৮ কোটি টাকা) 

 

ঢাকার আদালতে অর্থ পাচার মামলা চলার সময় ২০১১ সালে আমেরিকার ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের একজন এজেন্ট তারিকের বিরুদ্ধে প্রমাণ সহ সাক্ষ্য দিয়েছন। এ জাতীয় ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম। 

 

এ সি সি আরও জানতে পেরেছে যে, বসুন্ধর গ্রুপের চেয়ারম্যানের পুত্র সানভির সোভানের বিরুদ্ধে আনা হত্যা মামলা খারিজ করানোর জন্য তারিক ৩.১ মিলিয়ন ডলার উৎকোচ নিয়েছিলেন। বসুন্ধরা গ্রুপেরই একজন ডিরেক্টর, হুমায়ুন কবীরকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন সোভান। দেশের অন্যতম বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল কংগ্লোমারেট এই বসুন্ধরা গ্রুপ।

 

এ সি সি-র বক্তব্য অনুযায়ী, আল আমিন কন্সট্রাকশনের মালিক আমিন আহমেদকে দেড় লক্ষ ডলার না দিলে কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন তারিক। রেয়াজ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মহম্মদ আফতাব উদ্দিন খান, মির আখতার হোসেন লিমিটেডের মির জাহির হোসেন এবং হারুন ফেরদৌস সহ অন্যান্য বড় শিল্পপতিরাও প্রত্যেকেই জোর করে বহু লক্ষ ডলার আদায়ের অভিযোগ দাখিল করেছেন।

 

তারিকের দূর্নীতিমূলক কাজকর্ম শুধুমাত্র স্থানীয় কোম্পানিগুলির উপর জোর খাটিয়ে টাকা আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা। বেশ কিছু বিদেশি এবং দেশি শিল্পসংস্থা এবং ব্যক্তির থেকে ঘুষ নেবার প্রমাণও এ সি সি-র হাতে এসেছে।  তারিক এবং তাঁর ভাই আরাফত রহমান কোকো (এখন মৃত)-র নামে টেলিকম গোষ্ঠী সিমেনসের হয়ে উৎকোচ  পাঠানো একজন সাক্ষীর বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সিমেনসের পাওয়া সমস্ত বরাতের প্রত্যেকটির উপর তারিক দু' শতাংশ করে ঘুষ নিয়েছিল। ইউ এস ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস অ্যাসেট ফরফিচার এবং এফ বি আই এই কেসটি দেখছে।

 

এ সি সি আরও জানতে পেরেছে যে, চিনা নির্মাণ সংস্থা হারবিন কোম্পানি একটি কারখানা খোলার জন্য তারিককে সাড়ে সাত লক্ষ ডলার দিয়েছিল। তারিকের একজন বিশ্বস্ত অনুচর এই অর্থ নিয়ে সিংগাপুরের সিটিব্যাংকে জমা করেছিল। এ সি সি প্রকাশ করেছে যে, কন্ট্রাক্ট পাওয়ার জন্য মোণেম কোম্পানি তারিককে দিয়েছিল সাড়ে চার লক্ষ ডলার।

 

ভুয়ো জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট গঠন করে মা খালেদা জিয়ার সংগে তারিকের  ২.১০ কোটি আত্মসাৎ করার কথা সম্প্রতি সামনে এসেছে। ১৯৯১ সালের ৯ই জুন ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক থেকে প্রধানমন্ত্রীর অরফ্যানেজ ফান্ডে ১,২৫৫,০০০ ডলার (সেই সময় ৪.৪৫ কোটি টাকার সমান) পাঠানো হয়েছিল। অর্থ আত্মসাৎ করার মতলব নিয়েই এর মাত্র কয়েকদিন আগেই এই ফান্ড গঠন করেছিলেন খালেদা জিয়া এবং তারিক।

 

এ সি সি জানতে পেরেছে তারিক ২০০৬ সালে দুবাইতে ৬০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সম্পত্তি কিনেছিলেন। বি এন পি-র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এবং তারিকের অর্থপাচার, দূর্নীতি এবং উৎকোচ গ্রহণের  অভিযোগ নিয়ে সৌদি আরব যে তদন্ত করেছে, সংবাদমাধ্যমে সেই সংক্রান্ত প্রতিবেদন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামাজিক স্তরে সততা এবং আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন জাগিয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, খালেদা জিয়া এবং তাঁর দুই পুত্র উৎকোচ এবং জোর করে আদায় করা অর্থ দিয়ে সৌদি আরবে বিভিন্ন মল এবং পরিকাঠামোগত প্রকল্পে ১২ বিলিয়ন ডলার লগ্নি করেছিলেন। তাঁদের এই লগ্নির ব্যাপারটি এখন সৌদি কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধান করে দেখছে।

 

তদন্ত চলাকালে     অর্থপাচার, ঘুষ নেওয়া, জোর করে টাকা আদায় এবং সন্ত্রাসমূলক কাজকর্মের  আরও বিভিন্ন  ঘটনায় তারিকের জড়িত থাকার কথা  সামনে আসছে। তাঁর যে অসুস্থতার কথা বলা হচ্ছে, তার চিকিৎসা বাংলাদেশেই হতে পারে। তার জন্য অনির্দিষ্ট কালের জন্য লন্ডনে বসে থাকার প্রয়োজন হয়না। কিন্তু তবু তিনি ২০০৮ সাল থেকেই লন্ডন রয়েছেন। উদ্দেশ্য, পালিয়ে থেকে গ্রেপ্তারি এড়ানো।