Column

রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে বি এন পি-জামাতের ষড়যন্ত্র

রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে বি এন পি-জামাতের ষড়যন্ত্র

| | 04 Jun 2013, 06:45 am
এই বছরের শুরুর দিকে, যখন ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কার যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে রায় দিতে শুরু করেছে,

  সেই সময় থেকেই হিংসায় উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ, ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় চলেছে গোঁড়া ইসলামপন্থী এবং আইনরক্ষকদের মধ্যে সংঘর্ষ।উনিশশো একাত্তরে দখলদারি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যারা যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছিল, দেশজুড়ে ব্যাপক গন্ডগোল পাকিয়ে এবং অরাজকতা সৃষ্টি করে যাতে তাদের বিরুদ্ধে চলতে থাকা বিচার পন্ড করে দেওয়া যায় তারই সুচারু পরিকল্পনা করে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বি এন পি) এবং জামাত-এ-ইসলামির নেতৃত্বাধীন শক্তি এই হিংসাত্মক আন্দোলনে নেমেছে। অচলাবস্থা তৈরির উদ্দেশ্যে কোনও না কোনও অজুহাতে প্রায় দিনই ডাকা হচ্ছে হরতাল।এত সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামের জিগির তুলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা। 

 
 কাওয়ামি মাদ্রাসা-কেন্দ্রিক চরমপন্থী ইসলামি সংগঠন, হেফাজত-এ-ইসলামের সেক্রেটারি জেনারেল জুনায়েদ বাবুনগরি সম্প্রতি মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এক জবানবন্দীতে জানিয়েছেন যে,৫ই মে তারিখে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আয়োজিত হেফাজতের সমাবেশের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল  বি এন পি-জামাত জোট এবং তা করার পিছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনা সরকারকে তাড়ানো। তিনি এও স্বীকার করেছেন যে, তাঁর সংগঠনের কিছু সদস্য সেই দিন জামাত এবং বি এন পির ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে শাপলা চত্বর এবং বৈকুল মুকাররম মসজিদ অঞ্চলে তান্ডব চালিয়েছিল। গ্রেপ্তার হওয়া ঐ ইসলামি নেতা বি এন পি-জামাত জোটের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বজায় রাখা হেফাজতের ১৪ জন নেতার নামও করেছেন। তাঁর বক্তব্য থেকে প্রকাশ পেয়েছে যে, বি এন পি-জামাত সঙ্গে হেফাজতের কর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় দোকানে আগুন লাগিয়েছে এবং কোর আন শরিফ পুড়িয়েছে। এই তান্ডবের সময় চলেছিল যথেচ্ছ ভাঙ্গচুর, লুটপাট,  অগ্নি সংযোগ, বোমাবাজি এবং পুলিশের উপর আক্রমণ। 
  
 
বাবুনগরির বিবৃতি থেকে প্রকাশ, তিনি যখন হেফাজতের প্রধানকে বি এন পি এবং জামাতের সঙ্গে দলীয় কর্মীদের একযোগে হিংসায় অংশ নেওয়ার কথা জানান, তখন তাঁকে মুখ বন্ধ করে থাকতে বলা হয়। তাঁকে বলা হয়, "আমাদের আন্দোলন শুধুমাত্র ১৩-দফা দাবি নিয়ে নয়। এটা এখন সরকারকে ফেলে দেওয়ার আন্দোলন হতে যাচ্ছে। বি এন পি নেতৃত্বাধীন জোট আমাদের সব রকম সাহায্য দেবে এবং এ\'ব্যাপারে আমাদের বোঝাপড়া হয়ে গেছে। যতক্ষন না সরকারের পতন হয়, ততক্ষন আমরা ওখানে থাকব।"
একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার এই প্রচেষ্টা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি একটি বিরাট ষড়যন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আওয়ামি লীগ সরকারকে পাকিস্তান-প্রচারিত দ্বিজাতি তত্ত্বের শত্রু হিসেবে দেখা হয় এবং সেই কারনেই এই সরকার ইসলামি শক্তিগুলির চক্ষুশূল। 
           বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী গত বছর জানিয়েছিল  যে,  শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে ১২ জন \'ধর্মোন্মাদ\' অফিসারের চক্রান্ত তারা ব্যর্থ করে দিয়েছে। বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক বলেছিলেন \'ধর্মান্ধ\' সেনা অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা এক শ্রেনীর বিদেশ প্রত্যাগত বাংলাদেশী এই চক্রান্তে মদত দিয়েছিলেন। এগারোই ডিসেম্বর, ১৯১১ সালে ধরা পড়া ব্যর্থ অভ্যুত্থান চক্রান্তের বিশদ জানাতে গিয়ে ঐ মুখপাত্র তাঁর বিবৃতিতে বলেছিলেন, নিষিদ্ধ হিজব-উত-তহ্‌রির(এইচ ইউ টি) এর সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত। 
 
এই নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠনটি আবার বি এন পি-জামাতের সমর্থনপুষ্ট। সম্প্রতি ঢাকায় এরা বিপুল সংখ্যায় প্যামফ্লেট ছাপিয়ে আওয়ামি লীগ সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দেশে \'খেলাফত\' (শরিয়তি শাসন) প্রবর্তনের দাবিতে ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় সমাবেশ এবং মিছিল করার কথা ঘোষণা করেছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আওয়ামি লীগ সরকারকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে \'খেলাফত\' প্রবর্তন এবং অন্যান্য দাবি সম্বলিত এইচ ইউ টি\'র অসংখ্য পোস্টারও ঢাকা এবং ঢাকা শহরতলিতে দেখতে পাওয়া যায়। এই পোস্টারগুলিতে শেখ হাসিনাকে ভারত এবং আমেরিকাসহ \'ইসলাম-বিরোধী\' শক্তিগুলের \'এজেন্ট\' বলা হয়েছে।
  
 
         এর আগে, ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি তারিখে, অর্থাৎ ক্ষমতায় আসার দু\'মাসের মধ্যেই শেখ হাসিনা সরকারকে দেশের তৎকালীন সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস(বি ডি আর)-এর বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে হয়েছে। সরকার অবশ্য দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পন এবং অস্ত্রত্যাগ করাতে সক্ষম হয়। প্রথমিকভাবে এইসব বিদ্রোহীদের ক্ষমা প্রদর্শন করে শেখ হাসিনা সরকার কিন্তু আবার এক শ্রেনীর সামরিক অফিসারের ক্রোধের কারন হয়েছিল। যে হেতু বিদ্রোহীরা বেশ কিছু সেনা অফিসারকে হত্যা করেছিল, সেই হেতু তাদের ক্ষমা প্রদর্শনে বিক্ষুব্ধ কিছু সামরিক অফিসার এ\' ব্যাপারে কড়া অবস্থান নেওয়ার জন্য তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। 
 
          এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিয়ে সেনা অফিসাররা যাতে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যায়, তার জন্য বি এন পি-জামাত জোট সেই সময়ে চেষ্টার কোনও কসুর করেনি। সৌভাগ্যক্রমে অত্যন্ত বিচক্ষনতা দেখিয়ে জেনারেল মইন  তাঁর নেতৃত্বাধীন শৃংখলাবদ্ধ সেনাবাহিনীকে নিয়ে দৃঢ়ভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তা যদি না হত, তবে দেশে সেই ধরনের উথালপাথাল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত, যা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রফহমানের নৃশংস হত্যার সময়। সুতরাং, বি ডি আরের বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনার সরকারকে ফেলে দেওয়ার প্রথম চেষ্টা করা হয়। 
            
 
           উনিশশো উনপঞ্চাশ সালে জন্মলগ্নের সময় থেকেই আওয়ামি লীগ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিনিধি হয়ে কাজ করে এসেছে।তাদের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি নিয়েও এই দলটি বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক এবং উদার মুসলামান-প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের অবদান রেখেছে। এখনও দেশের বিশাল অংশের মানুষের মধ্যে তাদের সমর্থন-ভিত্তি আছে, যদিও      ক্ষমতার বৃহত্তর কাঠামোয় সামরিক বাহিনী, সংবাদমাধ্যম অথবা ব্যবসায়ী মহলের ভিতরে তারা বিশেষ প্রবেশ করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরম্পরাধন্য আওয়ামে লীগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষের বীরত্বগাথা এবং নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের কাহিনী, এবং যার ফলে দলটি একটি অনন্য প্রতীকী পরিচিতি লাভ করেছে।
 
এ সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরেই দলটিকে বারে বারে গণতন্ত্রে বিশ্বাস না রাখা এবং ধর্মের নামে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চাওয়া তথাকথিত জাতীয়তাবাদী ইসলামি এবং পাকিস্তানপন্থী শক্তিগুলির সহিংস চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। সামরিক বাহিনীর একটি অংশ, ভাড়াটে বাহিনী এবং পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি প্রায়ই জোট বেঁধে চেষ্টা করেছে গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ধ্বংস করতে এবং নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে। এই কাজ করতে গিয়ে এই শক্তিগুলি সবসময়ে ধর্মকেই সবথেকে সুবিধাজনক অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে।তাই তারা দেশের জন্য দাবি করেছে জাতীয়তাবাদী ঐস্লামিক পরিচিতি এবং দেশের মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতা বোধ সৃষ্টি করতে ভারত সম্পর্কে চালিয়ে গেছে নেতিবাচক প্রচার। 
নজিরবিহীন সংখ্যাধিক্য নিয়ে ২০০৮ সালে আওয়ামি লীগ-নেতৃত্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ক্ষমতায় ফিরলে তা বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতির উপর এক বড় আঘাত নিয়ে আসে। প্রমাদ গুনতে থাকা বি এন পি-জামাত জোট তাই সেই সময় থেকেই ক্রমাগত চেষ্টা করে চলেছে যেন তেন প্রকারে আওয়ামী লীগ সরকারকে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার।