Column

বিপরীত মেরুঃ জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া

বিপরীত মেরুঃ জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া

| | 01 Jun 2013, 01:26 am
উনিশশো একাত্তর সালের ২৫শে মার্চের রাতে দখলদারি পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা শহরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পরে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং চরমতম সংকটের কবলে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান।

সেই দুর্দিনে, যখন রাজনৈতিক নেতারা কোনও দিশা দেখাতে অপারগ, তখন বাঙ্গালি সামরিক অফিসার মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ২৬ ও ২৭শে মার্চের রাতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই সময় মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।তাঁর বাহিনী নিয়ে  মুক্তিযুদ্ধের সামনের সারিতে যোগ দেওয়া মেজর জিয়া চট্টগ্রাম ও নোয়াখালিকে কয়েকদিনের জন্য নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং বৃহৎ প্রস্তুতির জন্য সীমান্তের ওপারেও যান।

বাংলাদেশের  স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিকল্পনা এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে মেজর জিয়ার ভূমিকা অতুলনীয়। প্রথমদিকে সেক্টর ওয়ানের কম্যান্ডার হিসেবে এবং পরে \'জেড-ফোর্সের প্রধানের ভূমিকায় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে একজন বীর সেনানী হিসেবে তিনি নিজের পরিচয় রাখেন। তারই স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে তাঁকে সর্ব্বোচ্চ সামরিক সন্মান, \'বীর উত্তম\' খেতাব দেওয়া হয়। উনিশশো বাহাত্তর সালের জুন মাসে তাঁকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ পদে উন্নীত করা হয়। পরের বছরের মাঝামাঝি তিনি হন ব্রিগেডিয়ার এবং সেই বছরেরই শেষ দিকে মেজর জেনারেল পদ লাভ করেন।

উনিশশো পঁচাত্তর সালের ২৫শে জুন শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পরে যখন খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন, জিয়াউর রহমান তখন সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু সেই বছরেরই ৩রা নভেম্বর দেশে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই, ৭ই নভেম্বর তারিখে কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে আর একটি অভ্যুত্থান তাঁকে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।বস্তুতপক্ষে, সামরিক বাহিনী এবং অসামরিক মানুষদের গরিষ্ঠ অংশের সমর্থনে তাঁকে দেশের দায়িত্বভার গ্রহন করতে হয়। বিশৃঙ্খল বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে জারি করা হয় সামরিক আইন।

মুসলমানপ্রধান বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করিয়ে জনগনের ইচ্ছানুসারে সংবিধানের মুখবন্ধে \'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম\'(   কথাটি যোগ করা হয়। সংবিধানের ৮(১) ধারায় সমাজবাদকে \'আর্থিক ও সামাজিক ন্যায়\' হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এছাড়াও, ২৫(২) ধারায় বলা হয়, ইসলামি ঐক্য নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র মুসলমানপ্রধান দেশগুলির মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক রক্ষা এবং দৃঢ় করার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবে।

তাঁর শাসনকালে জিয়াউর রহমান \'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ\' ধারনাটির প্রসার ঘটিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশের  বহুমাত্রিক সমাজে, যেখানে বিভিন্ন জাতিসত্তা, ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং জীবনধারার প্রাচুর্য, সেখানে জাতীয়তাবাদের ধারনাটিকে ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত না করে আঞ্চলিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করাই যুক্তিযুক্ত। এর ফলে জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সমস্ত দেশবাসীকে এক সূত্রে বেঁধে জাতীয় ঐক্য এবং অখন্ডতার উপর জোর দেওয়া এক নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদ পুষ্ট হয়েছিল দেশে।


জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় আসেন তখন দেশের পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী ছিল বিশৃংখল অবস্থায়। অল্প দিনের মধ্যেই জিয়া আইন শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেন।পুলিশবাহিনীকে শক্তিশালী করে যেমন তিনি কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেন, তেমনি সামরিক বাহিনীতে শৃংখলাও ফিরিয়ে আনেন। এ ছাড়াও সেনা কর্মচারীদের সংখ্যা এক বছরের মধ্যে ৫০,০০০ থেকে বাড়িয়ে ৯০,০০০ করা হয়। তবে এসব করা সত্ত্বেও তাঁর আমলে সেনাবাহিনীতে বেশ কিছু বিদ্রোহ এবং অভ্যুত্থানের চেষ্টার ঘটনাও ঘটে, যদিও জিয়া সে সব কড়া হাতে দমন করেন।

গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জিয়া সেই সময়কার একদলীয় বাকশাল শাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক প্রথা ফিরিয়ে আনেন এবং নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলিকে পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ দেন। তাঁর সময়কালেই সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং সংবাদ পরিবেশনের অবাধ সুযোগ করে দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। একইভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয় বিচারবিভাগের স্বাধীনতাও। দেশে গণতান্ত্রিকতার ধারা ফিরিয়ে আনতে তিনি নিজে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। উনিশশো আটাত্তর সালে বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে প্রধান করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল। এর পরে ছয় দলের জোট, ন্যাশনাল ফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে জিয়া ৭৬।৬৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন।

উনিশশো আটাত্তর সালের পয়লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বি এন পি) আত্মপ্রকাশ করে এবং তিনি হন সেই দলের চেয়ারম্যান। পরের বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে বি এন পি ৩০০টি আসনের মধ্যে ২০৭টি জয় করে এবং জিয়া দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শাসনভার গ্রহন করেন। এর পরে ১৯৭৯ সালের পয়লা এপ্রিল তারিখে সংসদের প্রথম অধিবেশন ডাকা হয় এবং ৯ই এপ্রিল সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সামরিক শাসন তুলে নেওয়া হয়।

গতিশীন অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে চলা প্রেসিডেন্ট জিয়া জোর দিয়েছিলেন বেসরকারী ক্ষেত্রের উন্নতির দিকে।তাঁর নতুন উন্নয়ন নীতিতে যেমন উৎসাহিত করা হয় দেশী ও বিদেশী বেসরকারী পুঁজিকে, ্তেমনি বিশাল ভর্তুকি দিয়ে কৃষির অগ্রগতি ঘটাবারও চেষ্টা শুরু হয়। বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রীর রফতানি বাড়ানো যেমন গুরুত্ব পায় তেমনি খাদ্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় উল্লেখযোগ্যভাবে।


 আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের রাজনীতিকে পরিবর্তন করে করে তোলেন উৎপাদনমুখী। একটি কর্মসূচী তৈরি করে তিনি দলীয় কর্মীদের উৎসাহিত করতেন তার সফল রূপায়ন ঘটানোর জন্য। এই কর্মসূচীর মধ্যে প্রধান ছিল সেচের জন্য খাল কাটা এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণ। এছাড়াও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবার পরিকল্পনার উদ্যোগ যেমন তিনি নিয়েছিলেন, তেমনি সাধারন মানুষদের জন্য \'গ্রাম সরকার\' তৈরি করেছিলেন। এতসব উদ্যোগের ফলও মিলেছিল। দেড় বছরের মধ্যে প্রায় ১,৫০০ খাল কাটা অথবা সংস্কারের ফলে ১৯৭৬-৭৭ এবং ১৯৭৭-৭৮ সালে দেশে  রেকর্ড পরিমান খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়। গড় বার্ষিক জি ডি পি বৃদ্ধির হার ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল্ পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়ায় ৬।৮ শতাংশে।সেই সঙ্গে সর্বশিক্ষার জোরদার প্রচার, গ্রাম সরকার প্রথা এবং ভিলেজ ডিফেন্স পার্টির প্রবর্তন মানুষের মনে এক গভীর সদর্থক রেখাপাত করে।

বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও জিয়া বাংলাদেশকে একই সাথে উদার পশ্চিমী দুনিয়া, ভ্রাতৃপ্রতিম মধ্য প্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে উদীয়মান দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁরই সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ পায়। জিয়ার চিন্তার ফসল হিসেবে ১৯৮৫ সালে আত্মপ্রকাশ করে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়শন অফ রিজিওনাল কোঅপরেশান (সার্ক), যা অবশ্য তিনি দেখে যেতে পারেননি। উনিশশো একাশি সালের ৩০শে মে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন।

প্রথমে বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং পরে আধুনিক বাংলাদেশের কারিগর হিসেবে ইতিহাসে যে অবদান জিয়াউর রহমান রেখে গিয়েছিলেন, একজন প্রাক্তন মার্কিণ স্বরাষ্ট্র সচিব তাকেই \'বটমলেস বাসকেট\' বলে বর্ননা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী, দু\'বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে ছবিটা একেবারেই বিপরীত। রাজনীতিতে তাঁর অতি সক্রিয়তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক অতি বিস্ময়ের কারন।

এই খালেদা জিয়া এবং তাঁর দলের জোট সঙ্গী জামাত-এ-ইসলামির গোপন সমর্থন এবং পৃষ্ঠপোষকতাতেই বাংলাদেশে তালিবান কিংবা আল কায়দার  আদর্শ প্রচারকারী  চরমপন্থী ইসলামি সংগঠনগুলির আজ বাড়বাড়ন্ত। এই খালেদা জিয়াই ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে আসা জামাত-প্রধান, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের নাটের গুরু, গুলাম আজমের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এই গুলাম আজমের নেতৃত্বেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানপন্থী খুনে জঙ্গি বাহিনী দেশজুড়ে নির্বিচার খুন, ধর্ষণ এবং বিভিন্ন জঘন্যতম অপরাধ করেছিল।


সম্প্রতি খালেদা জিয়া এমন একটি কর্ম করেছেন যা শুধু যে দেশের মানুষকে বিরাটভাবে আঘাত করেছে তাই নয়, তাঁদের ক্রুদ্ধও করেছে। তিনি বলেছেন যেহেতু শাহবাগে আন্দোলনকারী আদর্শবাদী, নির্ভীক তরুণ-তরুণীরা \'জয় বাংলা\' স্লোগানে মুখর, সেই হেতু তাদের পিছনে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব টের পাওয়া  ্যাচ্ছে। এ ছাড়াও জামাতের সুরে সুর মিলিয়ে শাহবাগের এই সব ছেলে মেয়েদের \'নাস্তিক এবং বিকৃতমনা\' বলার ধৃষ্টতাও দেখিয়েছেন বি এন পি নেত্রী। বলা বাহুল্য, তাঁর এই সব কথা মানুষ মোটেও ভালভাবে নেয়নি।  

 

 ইতিহাসকে পরিকল্পিতভাবে অস্বীকার করে খালেদা জিয়া \'জয় বাংলা\' স্লোগান নিয়েই প্রশ্ন তুলে বলেছেন যে, স্বাধীনতা-উত্তর কালে বাংলাদেশে এই স্লোগান তার গ্রহনযোগ্যতা হারিয়েছে। কিন্তু এই স্লোগানই দেশের মুক্তিকামী মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আলোড়িত করেছিল। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক এই স্লোগান গলায় নিয়েই লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।

এই স্লোগানকে প্রথম হেয় করেন ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ। রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর শাসনক্ষমতায় এসে তিনি \'জয় বাংলা\'কে সরিয়ে চালু করেছিলেন পাকিস্তানি কায়দার স্লোগান,\'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।\'

শাহবাগের মঞ্চকে ঘৃণাভরে তাচ্ছিল্য করা খালেদা প্রকাশ্যে  বলেছেন এই বিশৃংখলার ফলে আরও রক্ত ঝরবে। এমন কথাও বি এন পি নেত্রী জানিয়েছেন যে, তিনি ক্ষমতায় ফিরে এলে \'গণহত্যা\'র দায়ে শেখ হাসিনার বিচার হবে। বুঝতে অসুবিধা হয়না, স্বাধীনতা সংগ্রাম চলার সময়ে গণহত্যায় জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে বলেই তার পালটা হিসেবে তিনি এই হুমকি দিয়ে রেখেছেন।

সারা দেশকে হতবাক করে দিয়ে খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার সরকারকে হিন্দুদের বাড়িঘর এবং মন্দির ধ্বংসের জন্য  দায়ী করেছেন।যেন এই লজ্জাজনক ঘটনার পিছনে তাঁর দল অথবা জামাতের কোনই হাত নেই। দু\'হাজার এক সালের অক্টোবর মাসে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার পরমূহুর্তেই বি এন পির নেতা এবং কর্মীরা যে রক্তাক্ত তান্ডব চালিয়েছিল তাও যেন এখন তাঁর দল মনে করতে পারছেনা।  


বাংলাদেশে \'মুসলমান আবগ\'কে \'আঘাত\' করা হয়েছে বলে খালেদা জিয়া ক্ষুব্ধ। কিন্তু একজন যুদ্ধাপরাধীকে মহীয়ান করার উদ্দ্যেশ্যে তার প্রতিকৃতির সঙ্গে যখন চাঁদের ছবি জুড়ে দেওয়া হয়, সেই ধর্মীয় অনাচারের ব্যাপারে তিনি নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করেন।

 

যুদ্ধাপরাধ-বিচার বানচাল করার উদ্দেশ্যে দাঙ্গা হাঙ্গামায় জড়ানো জামাত কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি প্রতিরোধের সাম্প্রতিক ঘটনাকে \'গণহত্যা\' আখ্যা দিয়ে সবাইকে বিস্মিত করেছিলেন খালেদা জিয়া। বিস্ময়ের কারন দু\'জায়গায়। প্রথমত, উনিশশো একাত্তর সালে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের হত্যালীলার ঘটনাকে খালেদা জিয়া কোনওদিন \'গণ হত্যা\' বলেছেন, এমনটা কেউ জানেনা। দ্বিতীয়ত, শব্দের এই অপব্যবহার তাঁর কোনও এক দুরভিসন্ধির ব্যাপারে অনেককেই নিশ্চিত করেছে। আসলে সেই অভিসন্ধি হল, তাঁর রাজনৈতিক মিত্র, পাকিস্তানপন্থী জামাতকে রক্ষা করা।

 সহজেই অনুমেয়, যে জামাতের দুই নেতা তাঁর রাজত্বকালে মন্ত্রী ছিলেন, সেই দলের অতীত কার্যকলাপের অন্তত প্রকাশ্য নিন্দা কখনও করবেননা।যে খালেদা জিয়া হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের পুনরুত্থান এবং পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিয়েছেন, তিনি রাতারাতি স্বাধীনতাপন্থী শক্তির সাথে হাত মেলাবেন, এমনটা কেউ আশাও করেনা।


যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি জামাত এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবির যখন হিংসাত্মক আক্রমণের রাস্তা নেয়, খালেদা জিয়া তখন প্রকাশ্যে তাদের পক্ষ নিয়েছেন।সেই সঙ্গে জামাত-শিবির কর্মীদের জাতীয় পতাকা পোড়ানো, শহীদ মিনার অপবিত্র করার মত কাজগুলি সম্পর্কে তিনি নীরব থেকেছেন। আর তাঁর নীরবতা জামাত-শিবির কর্মীদের আরও বেশি করে বাংলাদেশ বিরোধী এবং সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে।


ধর্মনিরপেক্ষ শাহবাগ আন্দোলনের দ্রুত বিস্তারে শঙ্কিত খালেদা জিয়ার সামনে তার বিরোধিতা করা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা ছিলনা। এর কারন, এই যুব-অভ্যুত্থানকে মেনে নেওয়া মানেই বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী ইসলামি রাজনীতির মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দেওয়া।"প্রথমে আমি বাঙ্গালি, তার পরে মুসলমান, হিন্দু অথবা বৌদ্ধ--" শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্ধৃত করে শাহবাগ আন্দোলনের তরুণ নেতাদের বলা এই কথাগুলি তো পাকিস্তানের প্রচার করা ধর্ম-ভিত্তিক দ্বিজাতি তত্ত্বকে খারিজ করে এবং ইসলামি রাজনীতির জন্য কোনও জায়গা রাখেনা।সুতরাং, চলতে থাকা এই আন্দোলন যদি শেষ পর্যন্ত সফল হয়, তবে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আগে বাঙ্গালি তারপরে মুসলমান, নাকি উল্টোটা, সেই ব্যাপারে বাংলাদেশের পরিচিতি নির্দিষ্ট করবে।


শাহবাগের ন্যায্য, দেশপ্রেমিক প্রতিবাদ-আন্দোলনকে নাস্তিকদের মিলনক্ষেত্র বলে প্রচার করার একটা অপচেষ্টা দেশজুড়ে করা হচ্ছে। খালেদা জিয়া নিজে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদন্ড এবং জামাতকে নিষিদ্ধ করতে চাওয়া এই সব তরুণ-তরুণীদের \'নাস্তিক এবং নষ্ট\' বলে গাল পেড়েছেন। সেই সঙ্গে ব্লগারদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা আহমেদ হায়দার রাজীব, যাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল,তাঁকে জামাত ও বি এন পি প্রতিদিন দানবসদৃশ রূপে প্রচার করছে।

খালেদা জিয়া জানেন শাহবাগ আন্দোলনের আদর্শ সামনের নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছে।সেই পরিস্থিতি নষ্ট করতেই পরিকল্পিত হিংসা এবং ঘন ঘন হরতালের মাধ্যমে দেশকে একটি দীর্ঘস্থায়ী অশান্তির মধ্যে ঠেলে দিতে চাইছে বি এন পি এবং জামাত।

মরীয়া খালেদা জিয়া এমনকি সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরও প্ররোচিত করতে চেয়েছেন।সম্প্রতি তিনি বলেছেন, মানুষ যখন মরছে, সেনারা তখন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারেননা এবং তাঁরা নিশ্চয়ই যথাসময়ে তাঁদের ভূমিকা পালন করবেন।মানিকগঞ্জে আয়োজিত একটি জনসমাবেশে তিনি এও বলেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে আরও কিছু প্রান যাবে। যে সব কথা তিনি বলেছেন তাতে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে অথবা রক্তপাতের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতায় ফিরে আসার আকাঙ্খা গোপন থাকেনি।

সত্যি বলতে, এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের যে, আক্রমণকারী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা একজন বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি পরে নবজাতক রাষ্ট্রকে চরম দারিদ্র, বেকারি এবং অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা থেকে মুক্ত করতে মনে রাখার মত কাজ করেছিলেন, তাঁর স্ত্রী হয়ে খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতা-বিরোধী পাকিস্তানপন্থী শক্তির পক্ষ নিয়ে নিজের দলকে প্রতিবিপ্লবের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। যা তিনি করছেন ও করতে চাইছেন, তা তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমান যা ভেবেছিলেন, তার সম্পূর্ন বিপরীত।খালেদা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন, দেশ এবং স্বাধীনতা বিরোধী, পাকিস্তানপন্থী জামাতের মধ্যে যে কোনও একটিকে বেছে নিতে হলে তিনি জামাতের দিকেই থাকবেন।