Column

তদারকি সরকা্রের দাবিঃ কয়েকটি কথা

তদারকি সরকা্রের দাবিঃ কয়েকটি কথা

| | 13 Jul 2013, 11:25 am
্যে তদারকি সরকারের দাবিতে বাংলাদেশের বিরোধী দল, বি এন পি আজ মুখর,সংবিধানে সেই প্রথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। এবং তা হয় সুষ্ঠু, ন্যায়সংগত নির্বাচন না হতে দেওয়ার জন্য তৎকালীন শাসকদল, এই বি এন পির-ই মরীয়া চেষ্টার পরিবর্ত ক্রিয়ায়।কি করেছিল সেই সময়ে বি এন পি ? গোটা গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই নষ্ট করে দিয়েছিল তারা সমস্ত প্রধান পদে দলীয় লোকদের নিয়োগ করে। এমনকি ভোটার তালিকায় কারচুপি করে জালিয়াতির পথে নির্বাচনে জেতার চেষ্টাও করেছিল বি এন পি। আর এই রকম একটি পরিস্থিতির ফলেই নির্বাচন যাতে ন্যায়সম্মতভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য শেষ পর্যন্ত সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তদারকি সরকারের প্রথা শুরু করা হয়।

 উনিশশো একাত্তরে বাংলাদেশ জন্মগ্রহন করার পরে দেশে ঘটে গেছে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থান এবং সেনা শাসন। গণ অভ্যুত্থানের ফলে ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে একটি অরাজনৈতিক তদারকি সরকারের অধীনে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে সমস্ত প্রধান রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের অগ্রণী প্রতিনিধিবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবীরা সর্বসন্মত সিদ্ধান্ত নেন। ঘন ঘন সামরিক শাসন রুখতে এবং দেশে

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এইভাবেই শুরু হয়েছিল তদারকি সরকার-প্রথা। পনের বছর টিঁকে থাকা এই প্রথা অনুযায়ী তদারকি সরকারের অধীনে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
 
এর পরে অবশ্য ২০১১ সালে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনের মাধ্যমে এই প্রথা তুলে দেওয়া হয়। এবং তা করা হয় নির্বাচন দেখভালের জন্য সংবিধানে তদারকি সরকারের ব্যবস্থা চালু করাকে সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ বলে ঘোষণা করায়।
 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন যে, আদর্শ সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র আদৃত \'ওয়েস্ট মিনিস্টার প্রথা\'র অনুসরনেই দেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন করা হবে। ব্রিটেন সফরের সময় সেখানকার সেক্রেটারি অফ স্টেট উইলিয়াম হেগের সঙ্গে একটি বৈঠকে তিনি বলেন তাঁর সরকার নির্বাচন কমিশনসহ সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকেই শক্তিশালী করেছে। এর কারন, এই সরকার বিশ্বাস করে যে, অব্যাহত গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
 
কিন্তু তদারকি সরকারের পুনঃপ্রবর্তনের দাবি তোলা বি এন পি এবং তার রাজনৈতিক মিত্ররা বলে চলেছে আওয়ামি লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা তাতে অংশগ্রহণ করবেনা।কারন হিসেবে এই দলগুলি অভিযোগ করছে যে, ক্ষমতাসীন জোটের অধীনে যদি নির্বাচন হয়, তবে তারা সেই নির্বাচনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে। তাই নিজেদের দাবির পক্ষে বিরোধীদের যুক্তি, তদারকি সরকার এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে এবং নির্বাচনে কোনও রকম সংবিধান বহির্ভূত কাজ এই ধরণের সরকার হতে দেবেনা।
 
দেশের মানুষের কিন্তু এখনও মনে আছে তদারকি সরকার গঠনের নামে কী করা হয়েছিল বিগত বি এন পি শাসনকালে। সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতির অবসরের সময় বাড়িয়ে দিয়েছিল খালেদা জিয়ার সরকার এই উদ্দেশ্যে যাতে তিনি তদারকি সরকারের প্রধান হতে পারেন। নির্বাচন কমিশনের প্রধান হিসেবে এমন একজনকে বেছেছিলেন খালেদা জিয়া, যিনি ১।৩ কোটি ভুতুড়ে ভোটারসহ একটি নির্বাচক তালিকা  উপহার দিয়েছিলেন দেশকে। এবার দেখা যাক কি হয়েছিল ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে, শাসনকাল সম্পূর্ন করে বি এন পি-নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গোপনে দলীয় আনুগত্য বজায় রাখা তথাকথিত তদারকি সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পরে। ওই সময়ে যে উত্তাল রাজনৈতিক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল বাংলাদেশে তার প্রাথমিক কারন ছিল এই যে, তদারকি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আয়াজুদ্দিন আহমেদ বি এন পির এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন এবং  নির্বাচনী প্রক্রিয়া দেখভাল করা তাঁর অধীনস্থ প্রশাসন বি এন পি যাতে আবার ক্ষমতা দখল করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালে একটা লোক দেখানো নির্বাচন করার চেষ্টা করছিল। এরই ফলশ্রুতি সামরিক হস্তক্ষেপ এবং তদারকি সরকারের পরিচালক হিসেবে সামরিক কর্তাদের আবির্ভাব। দুর্ভাগ্যজনক, এই ঘটনায়  বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রশাসনের ধারাবাহিকতা থেমে গিয়েছিল এবং সেনা-সমর্থিত অগণতান্ত্রিক সরকার দীর্ঘ দু বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পেরেছিল।সুতরাং এই সমস্ত ঘটনা, যা গণতন্ত্রের অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল এবং দেশকে ঠেলে দিয়েছিল গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে,  চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল তদারকি সরকারের খারাপ দিক।
 
দু\' হাজার তেরোর শেষে অথবা ২০১৪-র প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হতে চলা সংসদীয় নির্বাচনের আগে সেই তদারকি সরকার প্রথা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলে বি এন পি-নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা এখন ঘন ঘন দেশজোড়া হরতাল ডেকে, হিংসার আশ্রয় নিয়ে, সরকারি সম্পত্তি ও পথচলতি  গাড়ি ভাঙ্গচুর করে এবং আইন রক্ষাকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে--নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকারের উপর চাপ বাড়িয়ে তুলতে।এই দলগুলি একদিকে যেমন অগণতান্ত্রিক তদারকি সরকার
প্রতিষ্ঠার দাবিতে অনড়, অন্যদিকে তেমনি কোনও বিকল্প ব্যবস্থার খোঁজে কোনও আলোচনায় বসতেও এরা রাজি নয়।
 
যে বি এন পি-নেতৃত্বাধীন সরকারকে \'বর্বর, দুর্নীতিপরায়ণ\' আখ্যা দিয়েছিল \'দ্য ইকনমিস্ট\' পত্রিকা, ভাগ্যের পরিহাসে সেই সরকারের প্রধান খালেদা জিয়া এখন তদারকি সরকার গঠনের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছেন। দেশের মানুষ কিন্তু ভোলেননি ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সদ্য গণতন্ত্র ফিরে পাওয়া দেশের সব থেকে লজ্জাজনক নির্বাচনের অধিনায়কত্ব করেছিলেন তিনিই।
 
সংসদীয় নির্বাচন করানোর জন্য বাংলাদেশে তদারকি সরকারের কোনও প্রয়োজনই সুতরাং নেই। দেশের রাজনৈতিক নেতারা যথেষ্ট পরিণত এবং একটি অনির্বাচিত সরকারের তদারকি ছাড়াই তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। সব থেকে বড় কথা, পৃথিবীর কোনও প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশেই এই ধরণের অদ্ভুত প্রথা নেই।
 
তা হলে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কী দরকার? একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ছাড়াও এর জন্য প্রয়োজন আইন ও আদালত। এছাড়াও অবশ্যই থাকা দরকার এমন সংগঠন অথবা সংস্থার, যারা গণতন্ত্রের নিরপেক্ষ পাহারাদার হিসেবে কাজ করবে এবং সেই সাথে থাকবে শক্তিশালী গণমাধ্যম।
 
যে তদারকি সরকারকে সব সমস্যার সমাধান বলে বিরোধীরা দেখানোর চেষ্টা করছে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই যে, সেই সরকার নিজেই মূর্তিমান সমস্যা হয়ে দেখা দেবেনা, যেমনটা হয়েছিল ২০০৭ সালে। যে তথাকথিত তদারকি সরকার সেই সময় দু\'বছর ধরে লৌহ শাসনে রেখেছিল দেশবাসীকে,সেই সরকার আসলে বকলমে সামরিক শাসনই চালিয়েছিল, সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি এবং প্রতিষ্ঠানকে পদদলিত করে।
 
 
তাই গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করতে তদারকি সরকার নয়, বাংলাদেশের যা দরকার, তা হল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন একটি নির্বাচন কমিশন, যা অবাধ এবং ন্যায়সংগত নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করার ব্যাপারে অপরিহার্য।
 
আওয়ামি লীগ-নেতৃত্বাধীন সরকারের চার বছরে দেশে এ পর্যন্ত ৬,০০০ বিভিন্ন ধরণের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং নির্বাচনী দুর্নীতির কোনও গুরুতর আপত্তি অথবা অভিযোগ এখনও কোনও মহল থেকে এখনও তোলা যায়নি।এইসব নির্বাচনের অনেকগুলিতেই বিরোধী বি এন পির প্রার্থীরা জিতেছেন। সরকারের কোনও রকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই নির্বাচন কমিশন, যা এখন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, তার নিজের নিয়ম অনুসারেই এই নির্বাচনগুলি পরিচালনা করেছে। সুতরাং এ কথা বিশ্বাস করার কোনও কারন নেই যে, এই নির্বাচন কমিশন সবাইকে সমান সুযোগ দিয়ে দেশে অবাধ, ন্যায়সঙ্গত নির্বাচন করাতে পারবেনা।