Column

Biranganas felicitated

Biranganas felicitated

Bangladesh Live News | @banglalivenews | 23 Jul 2018, 07:24 am
নারী অধিকার সংগঠন নারীপক্ষ মার্চ মাসের ৮ তারিখে ঢাকার ধানমন্ডিতে তাদের দপ্তরে একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সংগ্রামের সময়কার বীরাঙ্গনাদের সংবর্ধনা দেয়।

বীরাঙ্গনাদের সহায়তাকল্পে এই সংগঠনটি ২০১১ সালে থেকে একটি প্রকল্প চালাচ্ছে, যার নাম "একাত্তরে যে নারীদের ভুলেছি।" সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি হয় নারীপক্ষের তরফ থেকে শাড়ি, লিফলেট এবং পোস্টার দেওয়ার মধ্য দিয়ে এবং এই কথা বলে যে, দেশ কখনও তার বীরাঙ্গনাদের ভুলবেনা।

 

একাত্তরের ন'মাসব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ঠিক কতজন মহিলা পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী, বিশেষত জামাতের লোকজনের যৌন নির্যাতন এবং লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন, তা জানা নেই। বিভিন্ন তথ্যে এই সংখ্যার তারতম্য আছে। কিন্তু তাঁদের ভয়ংকর কাহিনীগুলি এখনও তেমনই হৃদয় বিদারক, যেমন ছিল ৪৭ বছর আগে, যখন এইসব ঘৃণ্য অপরাধগুলি সঙ্ঘটিত হয়েছিল।

 

এই পাশবিক তান্ডব যারা চালিয়েছিল, তারা রাত্রি  বেলা বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে পরিবার পরিজনের সামনে মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতন করত। উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শাস্তি দেওয়া এবং সন্ত্রস্ত করে তোলা। অল্প বয়সী মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখা হত বিশেষ সেনা শিবিরে, আর সেখানে দিনের পর দিন গণধর্ষণ চলত তাদের উপর। সেনা শিবিরে আটক এই সব নারীদের অনেককেই পরে হত্যা করা হয়েছিল অথবা অসম্মানের লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি পেতে আত্মহত্যা করেছিলেন তাঁরা। অনেকে আবার অত্যাচারীদের হাতেই খুন হয়েছিলেন।

 

২০১৪ সালের ১৩ই অক্টোবর সরকার থেকে এই সব বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। একাত্তরের সংগ্রামের সময় যে সব নারী দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, তাঁদেরই স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সমান সম্মান দিয়ে তাঁদের এবং তাঁদের সন্তানদের কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অধিকারী করা হয়েছে।  সরকার থেকে এই বীরাঙ্গনাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করার কাজ, যদিও  পর্বতপ্রমাণ, শুরু হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে শেষ করা হবে।

 

আজকের বীরাঙ্গনাদের, যাদের একসময় অপহরণ করে বেশ্যালয়ে পরিণত হওয়া মিলিটারি ক্যাম্পে রেখে অত্যাচার করা হয়েছিল দিনের পর দিন, তাঁদের মর্মন্তুদ একটি কাহিনী প্রকাশিত হয়েছিল টাইম ম্যাগাজিনে ঃ

 

"ভয়ংকরতম যত তথ্য প্রকাশ পেয়েছে তার মধ্যে একটি বাঙালি মহিলাদের নিয়ে, যাদের মধ্যে অনেকেরই বয়স মাত্র ১৮, যাদের সংগ্রামের প্রথম দিককার সময় থেকেই ঢাকার ঘিঞ্জি মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন বাড়ি থেকে তুলে এনে সৈন্যদের যৌনদাসী হতে বাধ্য করা এই সব মেয়েরা সবাই তিন থেকে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাদের গর্ভপাত ঘটাতে সেনারা নাকি তাদের ছাউনিতেই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের এনেছিল, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল তাতে। এর পর সেনারা সেই মেয়েদের ছেড়ে দিতে শুরু করে এবং বাড়ির পথে পা বাড়ানোর সময় তাদের অনেকেরই কোলে তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের ঔরসে জন্মানো শিশু।" 

 

এই রকম বহু সহস্র মহিলাকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে দেহ গণকবরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, টুকরো করে দেওয়া হয়েছে তাঁদের স্তন এবং গোপনাঙ্গ। প্রাণে বেঁচে যাওয়া যে সব ধর্ষিতা পরিবার পরিত্যক্তা হয়েছিলেন,  তাঁরা অনেকেই গোপনে ভারতে চলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এঁদের অনেকেই তাঁদের শিশু সন্তানকে হত্যা করেছেন অথবা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ধর্ষণের শিকার এই সব মহিলাদের ভাগ্যে কোনও সম্মান জোটেনি পরিবার অথবা সমাজের থেকে। ধর্ষণের শিকার যাঁরা হয়েছিলেন, দেশের স্বাধীনতার পর তাঁদের 'সামাজিক আবিলতা' ও লজ্জার চিহ্ন বলে মনে করত সাধারণ পরিবারগুলি। তাঁদের অনেকেরই পরিবার 'সতীত্ব হারানো'কে চরম লজ্জাজনক ব্যাপার  মনে করে ঘরের মেয়ে-বউকে পরিত্যাগ করেছিলেন।

 

সংগ্রামের শেষে ধর্ষণের শিকার এই সব মহিলাদের দ্বিতীয় বার যাতনার মধ্যে দিয়ে যেতে হলো। ঢাকার ত্রাণ শিবিরে কাজ করা চিকিৎসকদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ১৭০,০০০ গর্ভপাত করানো হয়েছিল এবং জন্ম নিয়েছিল ৪৫,০০০ জারজ সন্তান। ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অফ জুরিস্টস-এর একটি রিপোর্ট বলেছে সঠিক সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, ব্রিটিশ এবং আমেরিকান সার্জনদের বিভিন্ন দল যে সমানে গর্ভপাত ঘটানোর কাজ করে গেছেন এবং দুর্ভাগ্যের শিকার এই সব মেয়েদের যাতে তাঁদের পরিবার গ্রহণ করে তার জন্য সরকারের করা নিরন্তর প্রচার থেকেই প্রমাণিত হয় কী ব্যাপক হারে ঘটেছিল ধর্ষণের ঘটনা।  

 

এই সব বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগ এবং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তাঁদের অবদানকে কোনওভাবেই ছোটো করা যায়না, কিন্তু তাও তাঁরা বহুদিন ধরে কোনও রকমেরই স্বীকৃতি পাননি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যে এঁদের যে অবদান, এর আগে কখনও স্বীকৃতি পায়নি।  বরং লোকে এদের সাথে দুর্ব্যবহার করে সমাজে একঘরে করে রেখেছে, যেন তাঁরা স্বেচ্ছায় কোনও ভুল পথে গিয়েছিলেন। মানুষ এটা বুঝতে পারেনি যে, সংগ্রামের সময় হানাদার পাকিস্তানি সেনারা এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা স্বাধীনতার যুদ্ধকে দমন করার উদ্দেশ্যে ধর্ষণকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। 

 

যে  অবর্ননীয় মানসিক যাতনার মধ্য দিয়ে একাত্তরের যৌন নিগৃহিতাদের যেতে হয়েছে, সে কথা ভেবেই এই সব দুঃখী মহিলাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে স্বীকৃতি জানিয়ে তাঁদের ও তাঁদের সন্তানদের কিছু সরকারি সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমানের শেখ হাসিনা-সরকার। দেরি হলেও এই মহান কীর্তি দেশ-বিদেশের সমস্ত মহল থেকেই প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন, তাঁর জন্যেই একাত্তরের এই বীরাঙ্গনারা এখন থেকে পুরুষ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মতই সম্মান ও মর্যাদা পাবেন।