Column

পাকিস্তানে ব্রাত্য বাংলাদেশি মুসলমানরা

পাকিস্তানে ব্রাত্য বাংলাদেশি মুসলমানরা

| | 04 Jul 2013, 12:59 am
পাকিস্তানে এই মুহুর্তে প্রায় তিরিশ লক্ষ বাঙ্গালির বাস, যাদের অনেকেই থাকেন করাচিতে।পাকিস্তানি সমাজের দরিদ্রতম অংশ এই মানুষেরা।

 কিন্তু সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে সেই দেশে এঁদের প্রায় সকলকেই স \'বিদেশি\' হিসাবে গণ্য করা হয়। এর কারন, এঁদের মধ্যে অত্যন্ত নগণ্য সংখ্যক মানুষের কাছে পাকিস্তানি নাগরিকত্বের সরকারি কাগজ আছে, বাকিদের কাছে তা নেই। উসমান টাউন বাঙ্গালি পাড়া এমনই একটি এলাকা, যেখানে বাঙ্গালিরা ছয় দশকের বেশি সময় ধরে বাস করে আসছেন। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানে এঁদের অনেকেরই বাস সেই ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় থেকেই। পাকিস্তানে এতদিনের বাসিন্দা হয়েও কিন্তু এইসব বাঙ্গালিরা ক্রমাগত মানসিক চাপ এবং হয়রানির মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যালিয়েনস রেগুলেটরি অথরিটি(নারা) এবং পুলিশ তাঁদের প্রায়ই হেনস্থা করে, কারন পাকিস্তানের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার মত কাগজপত্র  এঁদের কাছে নেই। আবার নাগরিকত্বের পরিচয় পত্র পেতে এঁরা যখন নারার কাছে দরবার করেন, তখন সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি করা হয় এবং এই সব গরিব মানুষরা পূরণ করতে পারবেননা, েএমন বিভিন্ন শর্ত খাড়া করে শেষ পর্যন্ত তাঁদের ফিরিয়েই দেওয়া হয়। যেখানে এই সব ব্যাপারে নারার যথাযথ পরিষেবা দেওয়ার কথা, সেখানে ওই সংস্থার কর্মীরা উৎকোচ দাবি করে এবং তা দিতে না পারলে প্রায়ই এই সব দরিদ্র বাঙ্গালিদের পাকিস্তানে অবৈধভাবে বসবাসের দায়ে  জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। 

 
নাগরিকত্ব না থাকার ফলে হাসপাতাল এবং বিভিন্ন ক্লিনিকগুলির মত গণ পরিষেবা সংস্থাগুলি থেকে পাকিস্তানে বসবাসকারী এইসব বাঙ্গালিদের ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। এমন কি পাকিস্তানি ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ড (এন আই সি) থাকা বাঙ্গালিদেরও  হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা পরিষেবা না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে,শুধুমাত্র বাঙ্গালি হওয়ার জন্যই, এমন ঘটনাও ঘটেছে। উনিশশো একাত্তরে বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরে পাকিস্তানে থাকা বহু বাঙ্গালিই সে দেশ ছেড়ে নতুন দেশে চলে এসেছিলেন। কিন্তু আশির দশকে তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবার একটু উন্নত জীবিকার খোঁজে ফিরে এসেছিলেন পাকিস্তানে।কিন্তু তাঁদের মধ্যে খুব সামান্য সংখ্যক মানুষই পেরেছেন পাকিস্তানের এন আই সি জোগাড় করতে।
 
পাকিস্তানে অভিবাসীদের দুর্দশা খতিয়ে দেখতে ইউনাইটেড নেশন্‌সের হিউম্যান রাইটস কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল সে দেশে ১৯৮০ সালে এসেছিলেন। সরেজমিন তদন্তে তাঁরা জানতে পারেন সে দেশে ৩৫ লক্ষ অভিবাসী আছেন, যাঁদের মধ্যে ২২ লক্ষ বাস করেন করাচিতে। এইসব মানুষদের ৯০ শতাংশই বাংলাভাষী।
 
করাচিতে বাঙ্গালি সম্প্রদায়ের মানুষদের ১১৬ টি বসতির মধ্যে মাচার কলোনি অথবা মুহম্মদি কলোনি এই রকমই একটি ঘিঞ্জি বস্তি এলাকা, যেখানে দু\'লক্ষের উপর মানুষ বাস করেন।"বাঙ্গালি সম্প্রদায়ের মানুষ সবসময় আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করেন। শহরে ঘুরতে থাকা পুলিশ প্রতিটি জায়গা থেকে বাঙ্গালিদের তুলে নিয়ে যায়," মাচার কলোনির ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রাক্তন নাজিম(প্রধান) ডঃ আলাদিন জানিয়েছেন।" আমি করাচিতে জন্মেছি। কেন আমি নিজেকে বিদেশি হিসাবে পরিচয় দেব?," বলেছেন ২৫ বছর বয়সী যুবক নুর-উল-হাসান।"আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কারন আমি বাঙ্গালি," জানিয়েছেন ৪০ বছর বয়সী শামসুদ্দিন। তাঁর নাগরিকত্বের পরিচয় হিসাবে পুরনো হয়ে যাওয়া একটি পরিচিতি পত্র দেখিয়ে শামসুদ্দিন বলেন, এটি থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফরেনারস অ্যাক্টের ধারায় ফেলে দু\'মাস গারদে আটক করে রেখেছিল।
 
"পবিত্র কোরানের নামে শপথ করে বলছি, আমি পাকিস্তানে জন্মেছি এবং আমি পাকিস্তানি। আমার বাবা এবং ছেলেও পাকিস্তানি। কিন্তু শুধুমাত্র বাঙ্গালি বলেই আমাকে সবসময় বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে," করাচির বস্তিতে থাকা আবদুল রহমান বলেছেন।তাঁর সোজা সরল কথাতেই বেরিয়ে আসে আত্মপরিচয়ের জন্য লড়াই করতে থাকা একটি প্রজন্মের করুণ কাহিনী। "বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করা মুসলিম লীগ ও জামাত-এ-ইসলামিকে আমরা সমর্থন করেছিলাম। সেই কারনে ১৯৭১-এ আমাদের টার্গেট করা হয়। ইসলামের মোহে আমরা এর পরে দেশ থেকে পালিয়ে এখানে আসি। কিন্তু এখানেও একই পরিস্থিতির শিকার আমরা। এবার বলুন, আমরা কোথায় যাব?," করাচির উপকূলবর্তী অঞ্চল, কোরাঙ্গির বাসিন্দা আবদুল বলেন। তিনি অবশ্য জানিয়েছেন, পাকিস্তানে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হয়ে থাকা সত্ত্বেও সে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে যাওয়ার কথা তাঁরা কেউই ভাবছেননা।আবদুলের মত  বহু বাঙ্গালি,যাঁরা স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের প্রধান সমস্যা এই যে, তাঁদের কাছে পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশ, কোনও দেশেরই কোনও বৈধ প্রমাণপত্র নেই। পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে পাকিস্তানে বহুদিন বসবাস করা সত্ত্বেও তাঁদের গায়ে \'বিদেশি\' তকমাই লেগে থাকে এবং পাকিস্তানি হিসাবে তাঁদের স্বীকার করা হয়না। এখন তাঁদের বাংলাদেশেও ফেরার উপায় নেই, কারন একসময়ে তাঁরা বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিলেন এবং সরকারিভাবে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে জন্মগ্রহন করার আগেই মাতৃভুমি ত্যাগ করেছিলেন।
 
অভিবাসীদের নাগরিকত্বের অবস্থান ঠিক করতে পাকিস্তান সরকার ফরেনার্স (অ্যামেন্ডমেন্ট),২০০০ অর্ডিনান্স-বলে ২০০১ সালে নারা গঠন করে।এর উদ্দেশ্য ছিল বে-আইনি ভাবে ঢুকে পড়া অভিবাসীদের সংখ্যা খতিয়ে দেখা, বিদেশিদের নথিভুক্ত করা এবং এদের মধ্যে পাকিস্তানে যারা কাজ অথবা ব্যবসা করতে চায়, তাদের অনুমতিপত্র দেওয়া। কিন্তু গত দশ বছরে মাত্র এক লক্ষ সতেরো হাজার আটশো জন বিদেশি নথিভুক্ত হয়েছেন, যেখানে নারার হিসাব মত মোট আটাত্তরটি দেশ থেকে আসা অন্তত পঁয়ত্রিশ লক্ষ বে-আইনি অভিবাসী পাকিস্তানে বাস করছেন।"বিদেশিদের নথিভুক্ত করার ব্যাপারে বেশ কিছু কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাদের।ভলান্টারি রেজিস্ট্রেশন প্রথায় কোনও কাজ হয়না।আমাদের দরকার পুলিশের সাহায্য, যাতে করে বিদেশিদের নাম লেখাতে বাধ্য করানো যায়," নারার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর মহম্মদ আলি লোধি জানিয়েছেন।
 
যে সব বাঙ্গালি ১৯৭৪ সালের আগে থেকে পাকিস্তানে আছেন, সে দেশের সরকার তাঁদের বসবাস করার প্রমান দাখিল করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার অনুমতি দিয়েছে। অন্যদিকে, যে সব অভিবাসী ১৯৭৪ সালের পরে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা নাগরিকত্বের অধিকারী নন। তবে তাঁরা নাম নথিভুক্ত করাতে এবং কাজের জন্য আবেদন করতে পারেন।নারার নিয়ম অনুযায়ী, তৃতীয় আর এক শ্রেনীর অভিবাসী, যাঁরা ২০০০ সালের ১০ই জুলাইয়ের পরে পাকিস্তানে এসেছেন, তাঁদের সে দেশে কাজ অথবা ব্যবসা করার কোনও অধিকার নেই এবং তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার কথা।