Column

গুলাম আজমঃ গণহত্যার নায়ক

গুলাম আজমঃ গণহত্যার নায়ক

| | 27 Jul 2013, 06:49 am
উনিশশো একাত্তর সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশের মানুষের বিরুদ্ধে নারকীয় মানবতা বিরোধী অপরাধ চালানোর মূল চক্রী, প্রাক্তন জামাত-এ-ইসলামি নেতা গুলাম আজমের সাজার আদেশ অবশেষে ঘোষণা করা হল আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত থেকে। খুনে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহত্যা সংগঠিত করার দায়ে আদালত আজমকে ৯০ বছরের কারাবাসের হুকুম দেওয়ার সাথে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অন্ধকারময় অধ্যায়ের উপর যবনিকা পড়ল।

 সুদীর্ঘ ৪৩ বছর লেগে গেলেও দেশের মানুষ খুশি এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত গুলাম আজমের বিচার ও দন্ডাদেশ হয়েছে।স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ন\'মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের যন্ত্রনা ও দুর্দশা ঘটানোর নায়ক ছিল এই ব্যক্তি।

 
গুলাম আজমের বিচার এবং দন্ডাদেশ মনে করিয়ে দেয় যে, অপরাধী এবং তাদের অপরাধকে ভুলে যেতে দেওয়া এবং আইনের হাত এড়িয়ে যেতে দেওয়া কখনওই উচিত নয়। একই সঙ্গে এই শিক্ষাও আমাদের নিতে হবে যে, একজন দুষ্কর্মকারী দশকের পর দশক ধরে বহাল তবিয়তে থাকতে পারে, কিন্তু একটা সময় আসবে যখন সে লুকোবার জায়গা পাবেনা। বিচারকরা বলেছেন,গুলাম আজমের মৃত্যুদন্ডই প্রাপ্য ছিল, কিন্তু তার বয়সের কথা চিন্তা করে কারাবাসের আদেশ দেওয়া হল। একজন  ধর্মীয় নেতা এই গুলাম আজমের যে কোনও আদেশ এক সময় একজন সেনা প্রধানের আদেশের থেকেও বেশি অলঙ্ঘ্য মনে করা হত।
 
সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে জামাত-এ-ইসলামি নেতারা সরকারকে এই বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, তাঁদের প্রাক্তন প্রধান এবং ধর্মীয় নেতা গুলাম আজমের কোনও রকম ক্ষতি হলে দেশের একজনও নিরাপদে থাকবেনা।
 
উনিশশো একাত্তর সালে সংঘটিত মানবতা-বিরোধী অপরাধ, গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে আজমকে ২০১২ সালের ১১ই জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আন ৬২টি নির্দিষ্ট যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের সবকটিই আদালতে প্রমাণিত হয়। একাত্তর সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তান-পন্থী যে খুনে বাহিনী দেশজুড়ে হত্যা, ধর্ষণ এবং অন্যান্য নানা ধরণের যুদ্ধাপরাধ চালিয়েছিল,  উচ্চমার্গীয় ইসলামি নেতা আজম তাদের নেতৃত্বে ছিলেন।
 
স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক দশদিন পরে বাংলাদেশে গণহত্যার স্থপতি, \'বেলুচিস্তানের কসাই\', জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে আজম তাঁকে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার ব্যাপারে জামাত-এ-ইসলামির পূর্ন সহায়তার আশ্বাস দেন। এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে \'ভারতীয়দের হস্তক্ষেপ এবং অণুপ্রবেশের ফল\' বলে বর্ণনা করে তিনি \'ভারতের দুরসভিন্ধি\' ব্যর্থ করতে \'দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী\'কে সবরকমভাবে সাহায্য করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
 
 
সুতরাং, যাদের তিনি \'দুষ্কৃতিকারী\' বলে বর্ণনা করেছিলেন, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে দখলদারি পাক বাহিনীকে সাহায্য করতে তিনি গড়ে তোলেন \'শান্তি কমিটি\'। উনিশশো একাত্তরের ২৫ শে মার্চ গণহত্যা সংঘটিত করার পরে কিন্তু দখলদারি পাক বাহিনী পূর্বতন পূর্বপাকিস্তানের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এবার সেই নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে এই শান্তি কমিটিগুলিকে বসিয়ে দেওয়া হল স্থানীয় সাধারন প্রশাসনের উপরে, যে প্রশাসনের  উপর সামরিক বাহিনী আস্থা রাখতে পারছিলনা।
 
মূলত জামাত-এ-ইসলামি থেকে বেছে নেওয়া এই শান্তি কমিটির সদস্যরা সাধারণ প্রশাসন এবং নাগরিকদের মধ্য থেকে ব্যক্তি বিশেষে সম্পর্কে খবরাখবর দিয়ে সামরিক বাহিনীর চর হিসেবে কাজ করেছিল। এছাড়াও হিন্দু নাগরিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং তাঁদের আত্মীয়-বন্ধুদের থেকে কেড়ে নেওয়া জমি ও দোকান বাজেয়াপ্ত করা এবং পুনর্বন্টণের দায়িত্বেও ছিল এই কমিটির সদস্যরা। এই সময়ে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তাঁদের সম্পত্তি লুঠ করে বাজেয়াপ্ত করেছিল এই কমিটির সদস্যরা।
 
 
মানুষের উপর নারকীয় অত্যাচার এবং লুঠতরাজ, নিরীহ সাধারন মানুষ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের  হত্যা করা, মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রী, মা এবং বোনেদের পাইকারি হারে ধর্ষণ--এই সবকিছুতেই শান্তি কমিটি এবং তার তিনটি শাখা, রাজাকার, আল বদর এবং আল শামসের যাবতীয় ভূমিকার নথিবদ্ধ প্রমাণ আছে পরবর্তীকালে করা বেশ কিছু সমীক্ষাতে।
 
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ মধ্যরাত্রে খুনে বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করে।ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ঘাতকরা সেই দিন এক রাতের মধ্যে হত্যা করেছিল ৭,০০০ মানুষকে। এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকার অর্ধেক মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন, খুন হয়ে গেলেন ৩০,০০০ নাগরিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে বীভৎস তাণ্ডবের বর্ননা দিয়ে ১৯৭১-এর ৩১শে মার্চ ঢাকার মার্কিণ কনস্যুলেট তাদের রিপো্র্টে জানিয়েছিল যে রোকেয়া হলের ভিতরে গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায়  সিলিং ফ্যান থেকে অনেকগুলি ঝুলন্ত, নগ্ন নারী দেহ পাওয়া গিয়েছে। অনুমান, ওই সব মহিলাদের ধর্ষণ করার পর গুলি করে হত্যা করা হয় এবং তারপর তাদের দেহগুলি দড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ওই বছরের ৩১ এপ্রিল সেই গণহত্যা এবং সামরকি বাহিনীর আক্রমণের সমর্থনে আজম শান্তি কমিটির সদস্যদের নিয়ে ঢাকার রাস্তায় একটি মিছিল বের করেন এবং তারপরে শতাব্দীর অন্যতম বীভৎস গণহত্যায় নেতৃত্ব দেন। \'পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক\' ,\'ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক\', ইত্যাদি স্লোগান তুলেছিলেন আজম ও তাঁর সমর্থকরা।
 
 সেই সময় দখলদারি পাকিস্তানী বাহিনীর কম্যান্ডারের লিখিত বিবরণ থেকেই প্রকাশ পায় যে, রাজাকার বলে কিছু ছিলনা অথবা স্বাধীনতা-বিরোধী কার্যকলাপে তারা যুক্ত ছিলনা বলে জামাত-এ-ইসলামি যে দাবি করে, তা কত মিথ্যা। সেই সময় আক্রমণকারী পাক বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেনারেল নিয়াজির লেখা  \'বিট্রেয়াল অফ ইস্ট পাকিস্তান\' বইটিতেই বর্নণা রয়েছে, কী ভাবে রাজাকার বাহিনী তৈরি হল, কেমন করে তাদের অস্ত্র শিক্ষা দেওয়া হত, কীভাবেই বা অস্ত্র যোগাড় করা হয়েছিল এবং কেমন করে আধাসামরিক প্রতিরোধ বাহিনী নামানো হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মোকাবিলা করতে। শুধু রাজাকারদের অস্ত্রশিক্ষা দিতেই একটি আলাদা বিভাগ খোলা হয়েছিল, যেখানে মেশিনগান, স্টেনগান এবং অন্যান্য মারণাস্ত্রের সম্ভার গড়ে তোলার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য জমা পড়ত।
 
 
জামাতের তৎকালীন মুখপত্র, \'দৈনিক সংগ্রাম\'-য়ের সমসাময়িক সময়ের সংখ্যাগুলি থেকেও আজমের  নানা ঘৃণ্য কাজকর্মে  জড়িত থাকার কথা জানা যায়। সেই সময়ে দৈনিক সংগ্রামে ছাপা তাঁর বক্তৃতার  রিপোর্টগুলির মধ্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, যে পাশবিকতা এবং বিপুল যুদ্ধাপরাধ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশকে গ্রাস করেছিল, তার নায়ক ছিলেন এই গুলাম আজম।
 
আজম নিজে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের সংগঠিত  গণহত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। "বিদ্রোহী এবং সমাজবিরোধীদের (পড়তে হবে মুক্তিযোদ্ধা) শারীরিকভাবে সরিয়ে দিয়ে আমাদের দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে," ঢাকায় একটি সমাবেশে তিনি বলেছিলেন।
 
পাকিস্তানকে \'ইসলাম ভূমি\' বলে বর্ণনা করে একসময় তিনি বলেছিলেন,"যদি মুসলমানরা পাকিস্তানের সংহতি ও ঐক্য সুরক্ষিত রাখতে না পারে, তাহলে সেই রাষ্ট্র এবং সেই সাথে ইসলামের অস্তিত্বই বিপণ্ন হয়ে পড়বে।
 
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অনিবার্য পরাজয় বুঝতে পেরে গুলাম আজমের নেতৃত্বাধীন জামাত-এ-ইসলামির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে  দখলদারি পাক বাহিনী বাংলাদেশকে বুদ্ধিজীবীশুন্য করে দেওয়ার ছক কষে। অত্যন্ত পরিকল্পনার সাথে যুদ্ধের শেষ কয়েকদিনে শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনীয়ার, শিল্পী ও লেখকসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে প্রথমে গ্রেপ্তার ও পরে নির্যাতনের পরে হত্যা করা হয়। উনিশশোএকাত্তরের ১৪ই ডিসেম্বর এমনই একটি দিন, যেদিন বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিলে, এবং সেই কারনে এই দিনটিকে স্বাধীন বাংলাদেশে \'শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস\' হিসেবে পালন করা হয়।
 
বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়ার পরেই আজম পাকিস্তানে পালিয়ে যান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি যাতে নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি না দেয়, তার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালাতে থাকেন। উনিশশো একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বরে দখলদারি পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরেও আজম তাঁর বাংলাদেশ বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে গিয়েছিলেন।পাকিস্তানে থাকার সময় তিনি \'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি\' নামে একটি সংগঠণের প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার বহুদিন পর পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যান আন্তর্জাতিক স্তরে একটি আন্দোলন গড়ে তুলে পূর্ব পাকিস্তানের পুনপ্রতিষ্ঠা ঘটাতে। এর জন্য তিনি এশিয়া, ইওরোপ এবং আফ্রিকার বহু দেশ ঘুরে বহু মিটিং করেছেন। একমাত্র সৌদি আরবেই তিনি গেছেন সাতবার এবং এর মধ্যে একবার সৌদি রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে অনুরোধ জানান। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পরে ১৯৭৮ সালে গুলাম আজম একবার পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশ এসেছিলেন। তখন তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটি পাকিস্তান-বাংলাদেশ কনফেডারেশন গড়ে তোলা।