Column
গণহত্যা স্মরণ দিবস
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ তারিখে 'অপারেশন সার্চলাইট' নামের আড়ালে পাক বাহিনী সারা বাংলাদেশ জুড়ে শুরু করেছিল গণহত্যার তান্ডব। ৩১শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করা হয় অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীকে। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ঘাতক বাহিনী সেই সময় এক রাত্রের মধ্যে হত্যা করেছিল ৭০০০ মানুষকে। এক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, আর খুন হয়ে গিয়েছিলেন ৩০,০০০ মানুষ। কয়েক হাজার ঐতিহাসিক প্রতিবেদনে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে।
{special_block_1}ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলা অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে আমেরিকান কনসুলেটের একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিবাস রোকেয়া হলে সিলিং-এ ঝুলন্ত ফ্যানের সঙ্গে পায়ে দড়ি বাঁধা অবস্থায় উলটো করে ঝোলানো সারি সারি নগ্ন নারী দেহ দেখা গিয়েছিল। হতভাগ্য ওই সব ছাত্রীকে ধর্ষণের পর গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
"এখানে, ঢাকায়, আমরা স্তব্ধ, আতঙ্কিত," লিখেছিলেন তখনকার আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড, স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে পাক বাহিনীর সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন যিনি। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে থাকা আমেরিকান কনসুলেটে পাঠানো টেলিগ্রামে তিনি বলেছিলেন, " এই প্রমাণ এখন ক্রমেই জোরদার হচ্ছে যে, বাড়ি থেকে বাইরে ডেকে এনে পরিকল্পিত ভাবে গুলি করে যে সব আওয়ামি লিগ সমর্থকদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের তালিকা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কাছে ছিল।"
২৫শে মার্চের রাতে শুরু হওয়া এই সংগ্রাম দীর্ঘ ন' মাস ধরে চলার পর স্বাধীনতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। এই সংগ্রাম ছিল দখলদারি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে, যাদের মধ্যে সব থেকে সংগঠিত এবং সক্রিয় ছিল জামাত। এদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি দখলদারি বাহিনী যে সব দানবিক অপরাধের ঘটনা ঘটিয়েছিল , তাতে নিহত হয়েছিলেন তিরিশ লক্ষের বেশি মানুষ, ধর্ষণ করা হয়েছিল আড়াই লক্ষের বেশি নারীকে। এছাড়াও অনাগত রাষ্ট্রটিকে নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল শ্রেষ্ঠ মেধার বাঙালিদের।সেই সময় ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের অনুরোধে এ দেশে কাজ করতে আসা ডাঃ জিওফ্রে ডেভিস নামে এক চিকিৎসকের মতে ধর্ষিতা নারীদের যে সংখ্যা সাধারণত বলা হয়, তা আসল সংখ্যার তুলনায় 'অনেক বেশি রক্ষণশীল।'.{special_block_2}
স্বাধীনতা সংগ্রাম চলার সময় এই সব স্থানীয় সহযোগীরাই পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সমর্থকদের হদিশ জানাত এবং তারপর তাদের অপহরণ করে হত্যা করত বিভিন্ন সেনা ছাউনি অথবা বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে। জ্বালিয়ে দেওয়া হত তাদের ঘরবাড়ি, লুট করা হত সম্পত্তি, তুলে নিয়ে যাওয়া হত হাজার হাজার বাঙালি মেয়েকে এবং তারপর সেনা ছাউনিগুলিতে বলাৎকার করা হত তাদের।
জামাতের গঠন করা আল বদর, আল শামস এবং রাজাকার বাহিনীর মত স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে পাক সেনারা সেই সময় রাত্রিবেলা অভিযান চালিয়ে বাড়ি বাড়ি ঢুকে পরিবারের লোকজনের সামনেই মেয়েদের উপর যৌন অত্যাচার চালাত। এর উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে আতংকে স্তব্ধ করে রাখা। অল্পবয়সী মেয়ে এবং মহিলাদের অপহরণ করে বিশেষ সেনা শিবিরে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হত। এই নারীদের অনেকেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন, নয়তো তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল।
বেশ্যালয়ে পরিনত এই সব সামরিক শিবিরে আটকে রাখা নারীদের নিয়ে সেই সময় টাইম ম্যাগাজিন প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছিল।
"সংগ্রামের প্রথম দিকে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন বাড়ি থেকে তুলে এনে ঘুপচি সেনা শিবিরে বন্দী করে রাখা ৫৬৩ টি নারী, যাদের মধ্যে অনেকেরই বয়স ছিল মাত্র ১৮, তাদের নিয়ে প্রকাশ পাওয়া একটি ভয়াবহ তথ্যে জানা গিয়েছে যে, এদের সবাই তিন থেকে পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্তা হয়ে পড়েছিল। জানা যায় যে, গর্ভপাত করানোর জন্য সেনারা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের আনিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছিল। এরপর সেনারা কয়েক জন করে সেই মেয়েদের ছেড়ে দিতে শুরু করে, আর পাক সেনাদের ঔরসজাত নবজাতকদের কোলে নিয়ে সেনা শিবির ছাড়ে সেই মেয়েরা। সেই সময়কার বেপরোয়া ধর্ষণ, নারকীয় গণহত্যা, বাড়ি ও সম্পত্তির ব্যাপক ধ্বংসসাধন এবং হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছড়িয়ে থাকা অথবা নদীতে ভেসে যাওয়া হাজার হাজার মৃতদেহের ছবি দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।
বর্তমানে চলতে থাকা যুদ্ধাপরাধ বিচার চলাকালীন বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী জামাত -সৃষ্ট অকল্পনীয় ভয়াবহতা এবং পাশবিকতার স্মৃতি আবার ফিরিয়ে এনেছে। যে বর্বরোচিত এবং বীভৎস পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা অথবা পঙ্গু করে দেওয়া হত, যে ভাবে যৌন অত্যাচার চালানো হত এ দেশের মেয়েদের উপর এবং তারপর তাঁদের ছিন্নভিন্ন দেহ ঠেসে দেওয়া হত নিকাশি নালা অথবা গণ করবের ভিতর, তার তীব্র বেদনাদায়ক বিবরণ থেকে সেই সব চিত্র যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
তাই অতি সংগতভাবেই বাংলাদেশের সংসদ ২৫শে মার্চ দিনটিকে "গণহত্যা স্মরণ দিবস" ঘোষণা করেছে। এই স্মরণ মনে পড়িয়ে দেয় অত্যাচারী পাক সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের পাশবিকতার কাহিনী।