Column
Trial of war criminals
ত্রিপাক্ষিক চুক্তিটিতে আরও বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অতীতের ভুলকে ভুলে যাওয়া এবং ক্ষমা করে দেওয়ার (ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ) আবেদন রাখছেন এবং তাকে সম্মান জানিয়েই ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দী পাক সেনার বিচার না করে ক্ষমা প্রদর্শন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার, যা ঘোষণা করছেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী। কিন্তু সেইমত পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দী সেনাদের দেশে ফিরে যেতে দেওয়া হলেও এর প্রতিদানসূচক কোনও আচরণ কিন্তু আজ পর্যন্ত করা হয়নি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে। যে ১৯৫ পাক যুদ্ধবন্দীকে বিনা বিচারে দেশে ফিরে যেতে দেওয়া হয়েছিল, তারা গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের মত জঘন্যতম কর্মে জড়িত ছিল।
{special_block_1}১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী যে বাংলাদেশে ব্যাপক অত্যাচার চালিয়েছিল, সে কথা উনিশশো চুয়াত্তর সালে বাংলাদেশ সফর করতে আসা পাকিস্তানের প্রাক্তন এবং বর্তমানে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো অস্বীকার করেছিলেন। ভুট্টো নিজে যেমন এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। পরবর্তীকালের অন্যান্য সরকারের পক্ষ থেকেও আনুষ্ঠানিক অথবা মৌখিকভাবে মার্জনা চাওয়া হয়নি।
একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কত সংখ্যক মানুষকে হত্যা করেছিল দখলদারি পাক সেনারা, আজও তার সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি। মোটামুটি রক্ষণশীল হিসেব অনুযায়ী, এই সংখ্যাটি তিরিশ লক্ষ। এ ছাড়াও হিন্দু ও মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের আশি লক্ষ থেকে এক কোটি মানুষ প্রান বাঁচাতে পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষাগুলিতে বলা হয়েছে সেই সময় পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তানে আনুমানিক সাড়ে চার লক্ষ নারীকে ধর্ষন করেছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা। যে ভয়ংকর অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল দখলদারি পাকিস্তানি সৈন্যরা, তা মানুষের বিবেক এবং মানবাধিকারের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বাঙালি মহিলাদের উপর অত্যাচারের তথ্যাবলী, যা পরবর্তীকালে বেশি করে প্রকাশ পেয়েছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে।
এই রকম কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প বয়সী মেয়েদের ভোগের বস্তু হিসেবে এক সেনা ছাউনি থেকে আর এক ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হত। তারও উপর যে সব নারকীয় অত্যাচার হত তাদের উপর তার মধ্যে ছিল স্তন কেটে নেওয়া অথবা বেয়নেট কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গোপনাঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া। এই ধরণের ভয়ংকরতম নিষ্ঠুরতার কোনও তুলনা নেই পৃথিবীর ইতিহাসে। এতটাই বেপরোয়া ভাবে নিরীহ অসামরিক মানুষদের হত্যা করা হত যে, শবদেহগুলি সরিয়ে ফেলার জন্য পেশাদের সাফাই কর্মীদের নিয়োগ করতে হত দখলদারি পাক সেনাদের।{special_block_2}
হামুদুর রহমান কমিশন নামে যে বিচারবিভাগীয় অনুসন্ধানকারী দল পাকিস্তান সরকার তৈরি করেছিল একাত্তর সালে দেশের সেনাবাহিনীর পরাজয়ের কারণ খতিয়ে দেখতে, তারাও পাকিস্তানি সামরিক অফিসারদের ব্যাপক অত্যাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সেই সঙ্গে অসামরিক ও সামরিক আইনশৃংখলা সম্পূর্নভাবে ভেঙ্গে পড়াকেই কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল।অত্যাচারের জন্য যে পাক সরকারের যে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিৎ, এ কথা এই কমিশন তার রিপোর্টে বলেছিল।
দু'হাজার সালে জেনারেল মুশারফ হুসেনের সামরিক সরকার ২০০ সালে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টটি 'ডিক্লাসিফাই' করার পর থেকেই পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনার দাবি প্রবল হয়ে ওঠে বাংলাদেশে। নির্মম আর বেপরোয়া ভাবে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, সৈন্য, অসামরিক জনতা, শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের হত্যা করার জন্য হামুদুর রহমান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে দোষী করেছিল। পাক বাহিনী যে সুপরিকল্পিত ভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বহু সংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানি মহিলাকে ধর্ষণ করেছিল, এই অভিযোগও কমিশন করে। রিপোর্টে সেই সময়কার পাকিস্তানি সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে নারী শিকারী এবং মদ্যপও বলা হয়। হামুদুর রহমান কমিশন সুপারিশ করে যে, এই সব অত্যাচার যারা করেছিল, তাদের বিচারের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আদালত গঠন করুক পাকিস্তান সরকার। কিন্তু তেমন কিছুই করা হয়নি।
২০০২ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় পাকিস্তানের ভূতপূর্ব সামরিক শাসক জেনারেল মুশারফ ১৯৭১ সালে "বাড়াবাড়ির জন্য দুঃখ এবং বেদনা" প্রকাশ করে একটি চতুর বিবৃতি তৈরি করেন। বাংলাদেশে আসা যে কোনও পাকিস্তানি নেতার দিক থেকে এই বিবৃতিটিই ক্ষমা অথবা মার্জনা চাওয়ার সব থেকে কাছাকাছি আসে। কিন্তু এই দুঃখপ্রকাশের অভিব্যক্তিকে খারিজ করে আওয়ামী লীগের অনুগামী স্বাধীনতার পক্ষে থাকা মানুষজন, বাম দলগুলি এবং সারা দেশের বুদ্ধিজীবীরা মুশারফের থেকে সম্পূর্ন এবং নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার দাবি তোলেন। মুশারফের এই ধরণের বিবৃতির উদ্দেশ্য ছিল ওই "দুঃখ" শব্দটিকে ব্যবহার করে যাতে বাংলাদেশে তাঁর মিত্রদল বি এন পি এবং জামাত অতীতের সেই অধ্যায়টি সমাপ্ত হয়েছে বলে দাবি করে পাকিস্তানের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে গভীরতম সম্পর্ক স্থাপনের দিকে এগোতে পারে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির পূর্বশর্ত হিসেবে যখন বাংলাদেশ ক্ষমাপ্রার্থনার দাবিতে অনড় রয়েছে, তখন মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছে পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রক। ২০১৫ সালের ২২শে নভেম্বর পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রক একটি বিবৃতি প্রকাশ করে, যাতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বি এন পি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হওয়াতে "গভীর উদ্বেগ এবং ক্ষোভ" প্রকাশ করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সরকারিভাবে প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানের বিবৃতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ধৃষ্টতাপূর্ন- এ কথা জানিয়ে ঢাকা আশা প্রকাশ করে যে, এর পর থেকে অসংগত বিবৃতি প্রদানের ব্যাপারে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল আচরণ করবে। এর পরের সপ্তাহেই ইসলামাবাদে কর্মরত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে ডেকে পাঠিয়ে একটি নোটে পাকিস্তানি বিদেশমন্ত্রকের তরফ থেকে একাত্তরে কোনও যুদ্ধাপরাধ অথবা অত্যাচারে পাকিস্তানের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করা হয়।
পাকিস্তান শুধুমাত্র বাংলাদেশে চলতে থাকা যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিরোধিতা করেনি, এ ব্যাপারে যাতে বাংলাদেশ সরকার পিছিয়ে আসে, সেই উদ্দ্যেশ্যে তার উপর চাপ সৃষ্টি করতে একটি আন্তর্জাতিক লবিকেও কাজে লাগিয়েছিল। উদ্দেশ্য, যুদ্ধাপরাধে নিজেদের ভূমিকা যাতে প্রকাশ না পায়। কিন্তু এ ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপকে উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধে স্থানীয় সহযোগীদের যারা পাণ্ডা, তাদের বিচারের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অনড় থেকেছেন।
সামরিক বাহিনীর করা গণহত্যা এবং অত্যাচারের মত অতি সংবেদনশীল ব্যাপারটিতে পাকিস্তান ক্রমাগতভাবে ক্ষমাপ্রার্থনায় অস্বীকার করায় বাংলাদেশ-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। যদি পাকিস্তানের তরফ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে সেই ঘটনার দায় নির্দেশ করতে যথাযথ বিচারবিভাগীয় পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয়, তবেই দু'দেশের মধ্যে সুস্থ এবং পারস্পরিক সহযোগিতামূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।