Column

Trial of war criminals

Trial of war criminals

Bangladesh Live News | @banglalivenews | 30 Apr 2018, 07:02 am
দীর্ঘ চার দশক পর গত শতকের একাত্তরে ঘটা যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করায় ব্সাংলাদেশ সরকারের বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পাকিস্তানের দৈনিক ডন। কিন্তু এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে, একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যে ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ ঘটেছিল, সে ব্যাপারে চল্লিশ বছর পর হঠাৎই ঘুম থেকে জেগে উঠেছে এ দেশের সরকার। বরং এ কথা বলাই সঠিক হবে যে, যে চরম অন্যায় এক সময় করা হয়েছিল দেশের বহু লক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষদের প্রতি, সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সে ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ এসেছে আজ। সারা দেশ আশান্বিত যে, একসময় অত্যাচার, নির্যাতনের বলি হয়েছিলেন যে সব মানুষ, তাঁদের পরিবার অবশেষে সুবিচার পাবে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যেই  শুরু করা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়া। এই উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল কোলাবরেটরস অ্যাক্ট এবং দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট । এই আইন দু'টি প্রণয়নের মূল লক্ষ্য ছিলে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় পড়া অন্যান্য অপরাধ কর্মে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক করা, বিচার করা এবং শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।

 

{special_block_1}১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার  যুদ্ধাপরাধীদের, বিশেষত গণহত্যা, ধর্ষন, ধ্বংসের তান্ডব চালানোর মত দানবিক কাজকর্মে পাক বাহিনীকে সরাসরি সহায়তা করা জামাতের এবং অন্যান্য ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলির শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন।  মানুষকে সন্ত্রাসে আচ্ছন্ন করে রাখতে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে গুঁড়িয়ে দিতে অভূতপূর্ব হারে যে সব  গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাট এবং ধ্বংসের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল সেই সময়, তাতে দখলদারি পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সহায়তা করে গিয়েছিল এই জামাত এবং অন্যান্য ইসলামি মৌলবাদী উগ্র সংগঠনগুলি।

 

এই লক্ষ্যে কোলাবরেটরস অ্যাক্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৯৭২ সালে কয়েকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়,  কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং কয়েক জনকে দোষীও সাব্যস্ত  হয়। কিন্তু পাকিস্তানপন্থি শক্তির হাতে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু হওয়ার পর কোলাবরেটরস অ্যাক্ট তুলে দেওয়া হয়।  যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে সামরিক একনায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের সংবিধানেরও সংশোধন করেন। আর এই ভাবে পাকিস্তানপন্থি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং জামাতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া হয় দেশের মাটিতে।

 

পঁচাত্তরের রাজনৈতিক ঝঞ্ঝার  পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার এসে  যুদ্ধাপরাধী সন্দেহে আটক মোট দশ হাজার বন্দীকে মুক্তি দেয় এবং বিচারের ব্যাপারটিকে ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 
যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়া আটকে দিয়ে  একাদিক্রমে ক্ষমতায় আসা সামরিক সরকার এবং বি এন পি নেতৃত্বাধীন সরকার মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার সমস্ত প্রচেষ্টাকে বিনষ্ট করে দিয়েছিল ভয় পেয়ে। ভয়- কারণ তা না হলে এদের অনেক সঙ্গীসাথি এই বিচারের আওতায় চলে আসত।

 

২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধ বিচারের যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন, তা সমগ্র জাতির মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। মানুষের যথার্থ দাবিকে পূর্ববর্তী সরকারগুলি বহুদিন ধরে অবহেলা করে আসায় যে নৈরাশ্য সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর হয়েছিল এই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এবং তার ফলে শেখ হাসিনার দল নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে। ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা বলেছিলেন, মানুষ ইতিমধ্যেই ব্যালটের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের পরাজিত করেছে এবং এখন তাঁর সরকার শুধুমাত্র আইনি পদক্ষেপ করবে।

 

এর পরে শেখ হাসিনা এমন কিছু প্রশংসনীয় ব্যবস্থা নেন, যার ফলে একাত্তরের সমস্ত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলির বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে একটি ঐকমত্য তৈরি হয়। এই পথে হেঁটেই  ১৯৭২ সালের আই সি টি অ্যাক্টের কিছু পরিবর্তন করা হয় যুদ্ধাপরাধের অবাধ বিচার এবং অভিযোগকারীদের শক্তিশালী করার পথ সুগম করতে।{special_block_2}

 

বিস্তৃত বিচার চলার পর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ছ'জন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এরা জামাত নেতা মতিউর রহমান নিজােমি, আলি আহসান মহম্মদ মোজাহিদ, আবদুলে কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মিরকাসেম আলি এবং সেইসঙ্গে বি এন পি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। জামাতের   সর্ব্বোচ্চ নেতৃবর্গের অন্যতম এবং বিরাট ব্যবসায়ী মিরকাশেম হলেন এই তালিকার ছ নম্বর ব্যক্তি। সাসপেন্ড হয়ে থাকা টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত টিভি সহ বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক মিরকাশেম ছিলেন জামাতের একজিকিউটিভ কমিটির সদস্য। বহু শতকোটি টাকা যুগিয়ে জামাতকে তিনি একটি মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।

 

জামাত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদি, সুপ্রিম কোর্ট যার মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে আমৃত্যু কারাবাসের  আদেশ দিয়েছিল, এখন জেলে। কারাদণ্ডের আদেশ বদলে ফের তাকে চরম দণ্ড দেবার আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দাখিল করেছে।

 

এ পর্যন্ত দু'টি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২৮ টি রায় দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ৫৩ জন ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৩১ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে করা ২৩ টি আবেদন-২২টি দণ্ডিত ব্যক্তিদের এবং একটি সরকারপক্ষ থেকে- এই মুহুর্তে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপেলেট ডিভিশনের সামনে রয়েছে।

 

দণ্ডিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে করা আপীলগুলি জামাত নেতা আবদুস সোভান এবং এ টি এম আজহারুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির নেতা সাইদ মহম্মদ কায়জার, জামাত থেকে আওয়ামী লীগ নেতা বনে যাওয়া মোবারক হোসেন, মহিদুর রহমান, ফরকান মল্লিক, সেরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, খান আক্রম হোসেন, ওবাইদুল হক তাহের, আতাউর রহমান নাঞি, শামসউদ্দিন আহমেদ, এস এম ইউসুফ আলি, শামসুল হক, মুহিবুর রহমান বড় মিয়াঁ, মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়াঁ, আবদুর রজ্জাক, সাখাওয়াত হোসেন, বিলাল হোসেন, মোসলেম প্রধান, আবদুল লতিফ, উজের আহমেদ এবং ইউনুস আহমেদের।

 

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ  আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী করা হয়েছে। আইনজ্ঞদের অভিমত এই যে, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভালভাবে করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির প্রাক্তন নাৎসি নেতাদের বিচার  করেছিল ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল নামে খ্যাত এই বিচার। এই ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে কোনও আপীল করতে দেওয়া হয়নি। 

 

কাম্বোডিয়ার গণহত্যা বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক যোগাযোগের দায়িত্বে থাকা হেলেন জারভিস এই ধরণের বিচার প্রত্যক্ষ করা অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন কাম্বোডিয়ার নরমেধের জন্য শুধুমাত্র  শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি্রাই   বিচারাধীন রয়েছে।  গণহত্যায় জড়িত থাকা সমস্ত মানুষের যদি বিচার করা হত, তাহলে হয়তো কাম্বোডিয়া আরও একটি গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হত, যে রকম একটি গৃহযুদ্ধ অতীতে দেশকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে জারভিস বলেছেন, জামাত-গঠিত সশস্ত্র বাহিনী- আল বদর, আল শামস এবং রাজাকারদের যারা নেতা ছিল এবং যাদের নির্দেশে ধর্ষণ, লুট, হত্যার মোট ঘৃণ্য অপরাধগুলি করা হয়েছিল, তাদের এই বিচারের আওতায় রাখা উচিত। ঠিক এই জিনিষটিই করা হচ্ছে বাংলাদেশে, যেখানে বিচার চলছে একমাত্র অপরাধের মূল পান্ডাদেরই। সমস্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ব্যবস্থা করা একটি পর্বতপ্রমাণ কাজ।

 

বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল যাদের দোষী সাব্যস্ত করে তাদের সকলেরই অধিকার আছে রায়ের বিরুদ্ধে  সুপ্রিম কোর্টে আপীল করার। পিটিশনের মাধ্যমে তারা রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাতে পারে। আই সি টি অ্যামেণ্ডমেনট অ্যাক্ট ২০০৯ অনুসারে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বিচারের সুযোগ নিতে পারে তারা।

 

ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের থেকে ভিন্ন চরিত্রের বাংলাদেশের    এই বিচার প্রক্রিয়ায় যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত যে কোনও ব্যক্তি তার পছন্দমত উকিল নিয়োগ করতে পারে। অভিযোগকারীর পক্ষের সাক্ষীকে পালটা প্রশ্ন করা এবং রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন দেয়ার অধিকার আছে তার। দীর্ঘ, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ বিচারের সুযোগ নিতে পারে সে।