Column
শত্রু সম্পত্তি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির পক্ষে রায় হাইকোর্টের
গত ২3 নভেম্বর রায় ঘোষণার পর বয়ানটি ১লা এপ্রিল প্রকাশ করা হয়েছে। আদালত বলেছে যে ১৯৬২ সালের পাকিস্তানি সংবিধানটি আইনের চোখে আদৌ কোনও সংবিধান নয়। সুতরাং সেই তথাকথিত সংবিধান অনুযায়ী শত্রু সম্পত্তি আইন প্রণয়ন একটি মিথ্যাচার।
'এনিমি (ভেস্টেড) প্রপার্টি অ্যাক্ট বাংলাদেশ' পাকিস্তানের ১৯৬৫ সালের এনিমি প্রপার্টি অ্যাক্টের উত্তরাধিকারী। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ 'জরুরী' পরিস্থিতি ঘোষণা করে ডিফেন্স অফ পাকিস্তান অর্ডিনান্স জারি করে। এই অর্ডিনান্সের উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা আইন প্রণীত হয়।
ডিফেন্স্ অফ পাকিস্তানের ১৭ নং রুল 'এনিমি ফান্ড' এর কন্ট্রোলারের নিয়োগের অনুমোদন দেয় এবং রুল ১৮২ শত্রু সম্পত্তি কাস্টডিয়ানের নিয়োগ অনুমোদিত করে। সেই অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আদেশ জারি করেন যে,পূর্ব পাকিস্তানে 'শত্রুদের' সমস্ত জমি ও বাড়ী এবং সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তির দায়িত্ব শত্রু সম্পত্তি রক্ষাকর্তার উপর ন্যস্ত থাকবে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তানি শাসকরা যে সব সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি বলে অভিহিত করেছিল, সেগুলি ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় হিন্দুদের ফেলে আসা সম্পত্তি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার এনিমি প্রপার্টি অ্যাক্ট প্রণয়ণ করে এইসব সম্পত্তির মালিকানা গ্রহণ করে এবং ১৯৭৪ সালে আইনটির নাম পরিবর্তন করে ভেস্টেড প্রপার্টি অ্যাক্ট নাম রাখা হয়।
.
বাংলাদেশের ন্যস্ত সম্পত্তি আইন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে চালু হওয়া এনিমি প্রপার্টি অ্যাক্ট , ১৯৬৫-র উত্তরসূরী। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কাস্টডিয়ানের 'শত্রু সম্পত্তি' নিরূপণ করার আর কোনও অর্থ থাকেনা। অথচ ১৯৬৯ সালে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের আগে পাকিস্তান সরকার শত্রু সম্পত্তি (জরুরী প্রবিধানের ধারাবাহিকতা) অধ্যাদেশ ঘোষণা করে,
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের উত্থানের পর, 'ল কন্টিনিউয়ান্স এনফোর্সমেন্ট অর্ডার, 1১৯৭১ নামে একটি রাষ্ট্রপতির আদেশ প্রণীত হয়। এই আদেশের আওতায় পাকিস্তানি আমলের যে সমস্ত আইনকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করা হল, সেগুলিকে রেখে দেওয়া হল। পরে, ২৬শে মার্চ, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ (সম্পত্তি ও সম্পত্তির ন্যায্যমূল্য) অর্ডিনান্স জারি হয়, যার অধীনে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের উপর ন্যস্ত যাবতীয় সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যতক্ষন পর্যন্ত এই ধরনের সম্পত্তি তাদের মালিক বা উত্তরাধিকারীদের কাছে ফেরত না যায়।
{special_block_1}এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধকালীন অবস্থায় সৃষ্ট এনিমি সম্পত্তি আইনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তাই বাংলাদেশ পাকিস্তান রাষ্ট্র অথবা তার সম্পদের এবং দায়ের উত্তরাধিকারী নয়। কিন্তু এই আইনটি রেখে দেওয়ায় তা বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের ক্লায়েন্ট এজেন্ট স্তরে নামিয়ে আনে।
পাকিস্তানে আইন প্রণয়নের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আইন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধকালীন অবস্থায় তৈরি হয়েছিল, তা কী ভাবে বাংলাদেশে বৈধ থাকতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও এই আইন চালু থাকলে এই অর্থই করা হয় যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধ হিসেবে অব্যহত রয়েছে। এর এই অর্থও হয় যে, ভারত ও ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশের শত্রু।
বাংলাদেশে এই আইনের ধারাবাহিক প্রয়োগের ফলে দেশের বিভিন্ন সরকার বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির সম্পত্তিকে শত্রুর সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলি বাজেয়াপ্ত করে নেয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ও জমি দখল করার জন্য এটি হয়ে ওঠে একটি হাতিয়ার। প্রকৃতপক্ষে এনিমি প্রপার্টি অ্যাক্ট হল পূর্ব পাকিস্তান থাকার সময় তৈরি হওয়া হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারাবাহিক বৈষম্যমূলক আইনগুলির চূড়ান্ত পরিণতি।
স্বাধীনতার পর ৪৭ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির রাজনীতিবিদরা নির্বাচনের আগে শুধুমাত্র হিন্দুদের ভোট পাবার জন্য এই অনিষ্টকর আইনটি বিলোপ করার কথা বলেছেন। কিন্তু তা শুধুমাত্র মুখেই। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম সরকার সদ্য স্বাধীন দেশের মূল্যবোধের বিপরীত সমস্ত আইন বাতিল করতে সম্মত হয়। কিন্তু বাতিল করার পরিবর্তে ঐ আইনকে 'ভেস্টেড প্রোপার্টি অ্যাক্ট'- নামে রেখে দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদ একটি আদেশ জারি করেন যে, কোনও নতুন সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা যাবে না এবং আশ্বাস দেন যে, এই ধরণের সম্পত্তিগুলি হিন্দুদের ব্যক্তিগত আইন দ্বারা পরিচালিত হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, হিন্দু সংখ্যালঘুদের সম্পত্তিকে ভেস্টেড প্রপার্টি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা অব্যাহত থাকে।
ভেস্টেড প্রোভাইড অ্যাক্টের বিধান অনুযায়ী, হাজার হাজার হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং আরও বেশ কিছু পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এই ব্যাপারটি বেশ কিছু মৌলিক অধিকারের বিষয় তুলে আনে, যেমন, মানবাধিকারের লঙ্ঘন, সম্পত্তি বরাদ্দকরণ, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুসারে উত্তরাধিকার আইন লঙ্ঘন, ধর্মের ভিত্তিতে জাতিগত বৈষম্য ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্যের মৌলিক আদর্শের অবমাননা, ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিশিষ্ট অধ্যাপক, আবুল বরকত সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। 'ইন্কুয়ারি ইনটু দ্য কজেস এন্ড কন্সিকোয়েন্সেস অফ ডিপ্রাইভেশন অফ হিন্দু মাইনরিটিজ ইন বাংলাদেশ থ্রু দ্য ভেস্টেড প্রপার্টি অ্যাক্ট" ৭৪৮, ৮৫০ পরিবার, যারা তাদের কৃষিজমি হারিয়েছে। এই বৈষম্যমূলক আইনটির ফলে যত জমি হিন্দু পরিবারগুলি হারিয়েছে, তার আনুমানিক পরিমাণ ১. ৬৪ মিলিয়ন একর (৬,৬৪০ বর্গকিমি), যা হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকারে থাকা মোট জমির ৫৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশের মোট ভূমি এলাকার ৫.৩ শতাংশ।
অধ্যাপক আবুল বরকত বলেন যারা এই বিতর্কিত আইনের মাধ্যমে জমি দখল করে লাভবান হচ্ছে, তারা সব দলের মধ্যেই আছে। বিএনপি-জামায়াতের শাসনকালে (২০০১-০৬) সবথেকে বেশি পরিমাণ জমি রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা হস্তগত করেছিল। জমি দখল করা এইসব ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৫ শতাংশই বি এন পি-র সংগে যুক্ত ছিল, ৩১ শতাংশ ছিল আওয়ামী লীগের সংগে, ৮ শতাংশ জামাত এবং ৬ শতাংশ জাতীয় পার্টির সংগে। তিনি দেখিয়েছেন যে, হিন্দুদের উপর সহিংস নিপীড়নের ঘটনা আওয়ামী লীগ শাসনকালের তুলনায় অনেকে বেশি ঘটেছে বি ইএন পি জামাতের শাসনের সময়।{special_block_2}
অধ্যাপক আবুল বরকত দেখিয়েছেন যে, ১৯৪৮ সালে থেকে সাবেক পূর্বপাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে থাকা হিন্দুদের জমির ৭৫ শতাংশই এই আইনের ধারাবলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশে জনসংখ্যার ০.৪ শতাংশেরও কম মানুষ ন্যস্ত আইন থেকে উপকৃত হয়েছেন এবং তা থেকে এটাই দেখা যায় যে ক্ষমতাসীন যারা, তার দূর্নীতির মাধ্যমে এই আইনটির অপব্যবহার করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা ৯ সেপ্টেম্বর, ২২০০৯ তারিখে ভেস্টেড প্রপার্টি অ্যাক্টটি খারিজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এই কাজ খুব কঠিন, কারণ বিভিন্ন স্তরে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা রয়েছে, এমন কি প্রশাসনের মধ্যেও একটি অংশ সম্পত্তি দখল করতে চায়।
.
যদি মূল হিন্দু মালিকদের বা তাদের বৈধ উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার প্রকৃত প্রক্রিয়াটি শুরু হয়, তাহলে কিন্তু শাসক এবং বিরোধী, উভয় দলের কর্মীরা বিপুল জটিলতা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, কারণ তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। এই ধরণের সম্পত্তির বৃহৎ অংশই দল নির্বিশেষে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের অনুগত লোকজনদের নিয়ন্ত্রণে আছে।